নন্দীগ্রামে পুলিশি গুলিচালনার সিবিআই-তদন্ত চেয়েছিলেন তিনিই। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সেই তদন্ত সেরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি যে রিপোর্ট পেশ করেছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন তা মানতে রাজি নন। কেন সরকার রাজি নয়, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিবিআই তদন্তের ‘খামতি’কেই হাতিয়ার করছে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর।
আর তাতেই নন্দীগ্রাম-কাণ্ড নিয়ে সিবিআইয়ের দীর্ঘ তদন্ত-প্রক্রিয়া কার্যত জলে যেতে বসেছে বলে মনে করছে রাজ্য প্রশাসনের একাংশ।
মহাকরণে পাঠানো নন্দীগ্রাম-চার্জশিটে সিবিআই লিখেছে, ২০০৭-এর ১৪ মার্চ ভাঙাবেড়ার দিক থেকে সশস্ত্র পুলিশের সঙ্গে ‘চটি পরা পুলিশ’ ছিল। তারাও উর্দিধারী পুলিশের পিছু পিছু ঢুকে তাণ্ডব চালায়। সে দিন ভাঙাবেড়া ও অধিকারীপাড়ায় ‘নিয়ম না-মেনে’ গুলিচালনার অভিযোগে দুই আইপিএস অফিসার ও তিন এসআইয়ের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের জন্য রাজ্যের অনুমতি চেয়েছে সিবিআই। এ ছাড়া এক ফরেন্সিক ডাক্তারের বিরুদ্ধেও মামলার অনুমতি প্রার্থনা করা হয়েছে, বিভাগীয় তদন্ত চাওয়া হয়েছে আরও তিন আইপিএসের বিরুদ্ধে। পূর্ব মেদিনীপুরের তদানীন্তন জেলাশাসক-সহ পাঁচ ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থারও (মেজর পেনাল্টি) সুপারিশ রয়েছে সিবিআই-রিপোর্টে।
কিন্তু ঘটনা হল, নন্দীগ্রামের ১৩০ জন আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধেও একই সঙ্গে চার্জশিট দিয়েছে সিবিআই। তাদের যুক্তি:, ঘটনার দিন পুলিশের নিষেধ সত্ত্বেও অবৈধ জমায়েত করে তারা পুলিশকে আক্রমণ করেছিল। ঘটনাচক্রে, ওই আন্দোলনকারীদের সকলেই যে শুধু তৃণমূল সমর্থক তা-ই নয়, বর্তমানে ওঁদের অনেকে তৃণমূলের টিকিটে জিতে আসা পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিও। যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি সিদ্ধান্তে ‘অন্য গন্ধ’ও পাচ্ছে প্রশাসনের একাংশ।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য মনে করছেন, পাঁচ পুলিশ অফিসার ও এক চিকিৎসকের নামে ফৌজদারি মামলার অনুমোদন দেওয়ার চেয়েও জরুরি হল পুরো ঘটনার পিছনে থাকা আসল মাথাদের খুঁজে বার করা। এ জন্য প্রয়োজনে তাঁর সরকার আদালতেও যাবে। মহাকরণের খবর: রাজ্যের অফিসারদের সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হবে কি না জানতে চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে স্বরাষ্ট্র দফতর যে ফাইল পাঠায়, তাতে আলাদা ‘নোট’ দিয়ে মমতা তাঁর এ হেন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। ‘চুনোপুঁটিদের ধরে কী লাভ? আসল পাণ্ডাদের ধরা হোক।’ নোটে লিখেছেন মমতা।
এর পরেই স্বরাষ্ট্র দফতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অভিযুক্ত অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমতি সিবিআই’কে দেওয়া হবে না। পরিবর্তে রাজ্যই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত করবে। তাতে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশাসনিক সূত্রের ইঙ্গিত, আদালতের নির্দেশে এ বিষয়ে সিবিআইয়ের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র দফতরের যে বৈঠক হতে চলেছে, তাতেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের এটা জানিয়ে দেওয়া হবে।
কেন এই সিদ্ধান্ত, সিবিআইকে লিখিত ভাবে তা ব্যাখ্যা করার তোড়জোড়ও শুরু হয়েছে মহাকরণে। এক আধিকারিক বলেন, “বহু লোক নিজেরাই থানায় গিয়ে শরীরের ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। সেই ক্ষত সত্যিই কার্তুজের কি না, সিবিআই তার রিপোর্ট রাজ্যকে দেয়নি।” যে সব কার্তুজের আঘাতে বিক্ষোভকারীদের অনেকে আহত হয়েছিলেন, সেগুলো ঘটনাস্থলে উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রগুলি থেকেই চালানো হয়েছিল কি না, সেই ‘ব্যালিস্টিক রিপোর্ট’ও মেলেনি বলে তাঁর দাবি।
সিবিআইয়ের চার্জশিটে মমতার আপত্তির কারণ ব্যাখ্যা করে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের এক কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, নন্দীগ্রামে পুলিশ পাঠানো ও গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
শ্রীনিবাসন, খেজুরি থানার ওসি অমিত হাতি ও সেকেন্ড অফিসার শম্ভু দাস-সহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পুলিশ অফিসার ও কর্মীরা। আন্দোলনকারীদের সতর্ক করার দায়িত্ব ছিল হলদিয়ার তদানীন্তন এএসপি তন্ময় রায়চৌধুরীর। সিবিআই সরকারকে জানিয়েছে, বিনা পরিকল্পনাতেই ভাঙাবেড়ায় পুলিশ মোতায়েন হয়েছিল। যার জন্য অরুণ গুপ্ত ও শ্রীনিবাসন ছাড়াও সে দিন তেখালি ফাঁড়িতে ঘাঁটি গাড়া তদানীন্তন ডিআইজি এন রমেশবাবুর দিকে আঙুল তুলছে সিবিআই। এই তিন আইপিএসের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করেছে তারা। অর্থাৎ এই তিন পুলিশ অফিসারের ক্ষেত্রে তদন্তের ভার থাকবে রাজ্যের হাতে।
কিন্তু গোল বেধেছে অন্যদের নিয়ে। কী রকম?
যেমন খেজুরির তৎকালীন ওসি অমিত হাতির ভূমিকায় অসন্তুষ্ট সিবিআই তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার পক্ষপাতী। সিবিআইয়ের দাবি, ওই সাব-ইন্সপেক্টরের যোগসাজশেই ‘চটি পরা পুলিশ’ গ্রামবাসীদের উপরে চড়াও হয়েছিল। অমিতবাবুর বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের আরও অভিযোগ, ঘটনাস্থলে পাওয়া বোমার থলি তিনিই খালে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক নির্দেশে নিরীহ গ্রামবাসীদের গ্রেফতার করেছিলেন, লোপাট করেছিলেন গুলিচালনার অন্যান্য প্রমাণ। আর সেকেন্ড অফিসার শম্ভু দাস তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বলে চার্জশিটে জানিয়েছে সিবিআই। সিবিআই দু’জনের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি মামলা করতে চেয়েছে। এ প্রসঙ্গে অমিতবাবু বলেন, “তদন্তাধীন বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।” শম্ভুবাবু কোনও কথা বলতে রাজি হননি।
অধিকারীপাড়ায় গুলিচালনার জন্য আরও তিন অফিসারের বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছে সিবিআই। এঁরা হলেন তখনকার তমলুকের এএসপি দেবাশিস বড়াল, হাওড়ার এএসপি সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (দু’জনেই আইপিএস) এবং নন্দীগ্রাম থানার তদানীন্তন ওসি শেখর রায়। অভিযোগ, গুলি চালানোর ক্ষেত্রে তাঁরা নিয়ম মানেননি। সিবিআইয়ের দাবি, পুলিশ যত রাউন্ড গুলি চালানোর কথা বলেছে, বাস্তবে চলেছে আরও বেশি।
এ প্রসঙ্গে শেখরবাবু বলেন, “আমরা সরকারি চাকুরে। প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নেবে, তা মাথা পেতে নিতে হবে।” দেবাশিসবাবু ও সত্যজিৎবাবুর বক্তব্য, “সিবিআইয়ের চার্জশিট সম্পর্কে সরকারি ভাবে কিছু জানি না। তাই মন্তব্য করব না।”
সে দিন নিহতদের আঘাত চিহ্নিত করেছিলেন, এমন এক ফরেন্সিক-চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও মামলা করতে চেয়েছে সিবিআই। সিবিআই-সূত্রের খবর: নিহত ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জনকে শনাক্ত করা গিয়েছিল। চারটি দেহে গুলির আঘাত চিহ্নিত করেন তমলুক হাসপাতালের ডাক্তার প্রদীপ দাস। তিনটিতে গুলির আঘাত দেখতে পেয়েছিলেন কলকাতা থেকে যাওয়া চিকিৎসক তাপস বসু। অন্য ছ’টি দেহে আঘাতের চরিত্র পরীক্ষা করেছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন ফরেন্সিক-প্রধান লক্ষ্মীকান্ত ঘোষ। তিনি তিনটিতে গুলির আঘাত, দু’টিতে বোমার আঘাত এবং একটিতে ‘স্পষ্ট কিছু না-বোঝার’ কথা জানিয়ে রিপোর্ট দিয়েছিলেন। কিন্তু সিবিআইয়ের দাবি, তাদের নিজস্ব ফরেন্সিক পরীক্ষায় ১৪টি দেহেই গুলির আঘাত মিলেছে। এর প্রেক্ষিতে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ওই ডাক্তারের দিকে আঙুল তুলেছে সিবিআই। এ ব্যাপারে লক্ষ্মীকান্তবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আট মাস আগে অবসর নিয়েছি। সিবিআই কী বলেছে, জানি না।”
কিন্তু ওই পাঁচ পুলিশ অফিসার ও এক ডাক্তারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার অনুমতি না-দেওয়ার পিছনে ওঁদের বাঁচানোই তৃণমূল সরকারের মূল উদ্দেশ্য কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনের অন্দরে। সরকারি কর্তাদের একাংশের মতে, চার্জশিটে সিবিআই ১৩০ জন আন্দোলনকারীরও নাম জুড়েছে, যাঁদের অধিকাংশ এখন স্থানীয় তৃণমূলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমতি দেওয়া হলে তাঁদেরও সিবিআইয়ের জালে জড়িয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাই সিবিআই-তদন্তের পুরো প্রক্রিয়াটাই সরকার বানচাল করে দিতে চাইছে বলে এই মহলের অভিমত।
এ ব্যাপারে তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “১৩০ জন আন্দোলনকারীর নামও যদি চার্জশিটে থেকে থাকে, তা হলে তো বলতে হবে, সিবিআই হামলাকারীদের রক্ষাকর্তা হয়ে অবতীর্ণ হয়েছে!” |