রীতিমতো ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মূর্তি গড়ছেন অপূর্ব পাল। বর্ষা আর মেঘলা আবহাওয়ার জন্য এমনিতেই ক’দিন মার খেয়েছে কুমোরটুলির কাজ। এ বার সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্রমিকের অপ্রতুলতা। ১০০ দিনের কাজ আর পঞ্চায়েত ভোটে টান পড়েছে শিল্পী-সহায়ক-জোগাড়ের জোগানে। বাড়তি মজুরি দিয়ে লাগাতে হচ্ছে শ্রমিকদের। মিন্টু পাল, নিমাই পাল, সুজিত পালের মতো শিল্পীদের অবস্থাটাও একই রকম।
এ বার ৪০টি দুর্গাপ্রতিমার বরাত পেয়েছেন অপূর্ববাবু। বললেন, “শ্রমিক না-পাওয়ায় প্রথমেই আমরা মার খেয়ে গিয়েছি।” কী ভাবে? তাঁর কথায়, “দুর্গাপুজো আর কালীপুজোর মাঝে প্রতিমা তৈরির নিরিখে নামমাত্র সময় থাকায় চৈত্র থেকে আষাঢ় মাসের মধ্যে কালীপ্রতিমার প্রাথমিক কাজটা এগিয়ে রাখি। ওই সময়ে কুমোরটুলির শ্রমিকদের গড় মজুরি থাকে কমবেশি ২৭৫ টাকা। কিন্তু ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজের সুযোগ বেশি মেলায় ওঁদের আর পাওয়া যায়নি।” ষষ্ঠীর দিন দুর্গাপ্রতিমা যখন পাড়ায় পাড়ায় যেতে শুরু করে, গুদাম থেকে অসম্পূর্ণ কাঠামো বার করে শুরু হয় কালীপ্রতিমা শেষ করার কাজ। “এ বার আমরা ফ্যাসাদে পড়ব,” বলছেন অপূর্ববাবু।
গত বছর পুজোর ভরা মরসুমে কুমোরটুলির ছোট শিল্পীদের গড় দৈনিক মজুরি ছিল ৬৫০ টাকা। এ কথা জানিয়ে অপূর্ববাবু বলেন, “এ বার দৈনিক অন্তত ১০০ টাকা করে বেশি না দিলে ওঁদের পাওয়া যাচ্ছে না। আমার নিয়মিত সহায়কদের মধ্যে সুতিয়ার নিধুরাম পাল, ঘাটালের অশোক পাল, নদিয়ার সৌমেন পাল গ্রাম থেকে এখানে এসেছেন দেরিতে। ১০০ দিনের নানা প্রকল্পে গ্রামে কাজ করছিলেন ওঁরা। অভিজ্ঞদের সময়মতো না পাওয়ায় প্রতিমা তৈরির কাজ পিছিয়ে গিয়েছে।”
কথাটা স্বীকার করলেন ঠাকুর পাল। এক দশকের উপরে পুজোর ক’মাস কুমোরটুলিতে সহায়কের কাজ করছেন তিনি। জানালেন, “চৈত্র-বৈশাখ মাসে ১০০ দিনের কাজের সুযোগ পাচ্ছিলাম। ডায়মন্ড হারবারে সেই সময়ে রাস্তা তৈরি, পুকুর-কাটার কাজ করেছি। কুমোরটুলিতে তখন আমাদের মজুরি ছিল কম। এখন বেশি টাকা দেওয়ায় এখানে এসেছি।”
ঠাকুর পাল কুমোরটুলিতে প্রতিমা তৈরির কাজে এলেও আসেননি সন্ন্যাসী পালের মতো অন্তত ৭৫ জন শিল্পী বা সহায়ক। বাড়তি আয়ের সুযোগ পেয়ে চলে গিয়েছেন বিভিন্ন রাজ্যে। কেবল উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরের কাছে প্রতিমা তৈরির জন্য গোন্ডায় ঘাঁটি গেড়েছেন সন্ন্যাসী পাল-সহ ১১ জন। সন্ন্যাসীর বাড়ি কৃষ্ণনগরের কাছে মুরাগাছায়। ফোনে গোন্ডা থেকে জানালেন, “মাসখানেক আগে এখানে এসেছি। কবে ফিরব ঠিক নেই। এখানেও থেকে যেতে পারি।”
আর এক প্রতিমাশিল্পী মিন্টু পাল বলেন, “পঞ্চায়েত ভোটের জন্য সহায়কেরা চলে গিয়েছিলেন। এতেও মার খেয়েছে কাজ।” কুমোরটুলিতেই ১৭টি প্রতিমা তৈরির বরাত পেয়েছেন মিন্টুবাবু। শিলিগুড়ি, বর্ধমান ও ছত্তীসগঢ়ে আরও তিনটি প্রতিমা হচ্ছে তাঁর। কপালে তাই চিন্তার ভাঁজ।
একই সমস্যা নিমাই পালের। বললেন, “এমনিতেই বৃষ্টি হল কুমোরটুলির অসুর। তার উপরে ১০০ দিনের কাজ আর পঞ্চায়েত ভোটের জন্য সময়মতো পর্যাপ্ত শ্রমিক মেলেনি। অল্প সময়ে কাজ শেষ করতে হবে।”
বাড়তি টাকা দিয়ে শিল্পী ও সহায়ক আনতে হলেও প্রতিমার দাম বাড়িয়ে তা আদায়ের সুযোগ কম। পুজোর ক’টা দিনের আয়ের উপরে অনেকটাই নির্ভরশীল কুমোরটুলি। ভবিষ্যতের প্রশ্নে তাই একটা অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরছে শিল্পীদের।
|