ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি কোনও বিষয়ে একমত হইতে পারে না, যে কোনও প্রশ্নে শাসক এবং বিরোধী দুই শিবির দুই বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে, সর্বদলীয় ঐকমত্য সোনার পাথরবাটি। ঠিক? না, ভুল। সচরাচর কোনও বিষয়ে দলগুলিকে সহমত হইতে দেখা যায় না বটে। সংসদ সাক্ষী দলীয় সহমতের অভাবে মহিলা সংরক্ষণ বিল অথবা জমি অধিগ্রহণ বিলের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন-প্রস্তাবও অধিবেশন হইতে অধিবেশন রিলে রেসের দণ্ডের ন্যায় হস্তান্তরিত হইতে থাকে। দলীয় বিভাজনের ফেরে পড়িয়া ভারতীয় গণতন্ত্র প্রায়শই ন যযৌ ন তস্থৌ। এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ একশোয় একশো পাইবে, কিন্তু ভারতও খুব কম পাইবে না। ঐকমত্য এই দেশে সত্যই দুর্লভ। কিন্তু সম্পূর্ণ বিরল নহে। রাজনৈতিক দলগুলি যখন দেখে, তাহারা দল হিসাবে বিপাকে পড়িতে চলিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের একমত হইতে কিছুমাত্র অসুবিধা হয় না। তখন সর্বদলীয় সভা ডাকিবামাত্র অথবা না ডাকিলেও সবাই সোৎসাহে সমবেত হয় এবং এমন নির্ভুল সমন্বয়ে বৃন্দগান জুড়িয়া দেয় যে ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়ারও চমৎকৃত হইবে।
অধুনা এমনই বৃন্দগান শোনা যাইতেছে রাজধানী দিল্লিতে। লোকসভার বাদল অধিবেশন হয়তো পূর্ববর্তী বিবিধ অধিবেশনের মতোই দলাদলির অভিঘাতে বানচাল হইয়া যাইবে, আইনসভার দায়দায়িত্ব সকলই নির্বাচনী লড়াইয়ের প্রলয়পয়োধিজলে ভাসিয়া যাইবে, কিন্তু অন্তত দুইটি প্রশ্নে বিভিন্ন দল ইতিমধ্যেই এক ধরনের সর্বসম্মতিতে পৌঁছাইয়া গিয়াছেন এবং প্রয়োজনে সেই মতৈক্য আইন সংশোধনের কাজেও ব্যবহৃত হইবে, এমন সম্ভাবনা প্রবল। এই আশ্চর্য সহমতের কারণ, দুইটি বিষয়েই রাজনৈতিক দলগুলি বিপাকে পড়িয়াছে। এক, সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়াছিল, আইনসভার সদস্য গুরুতর অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হইলে বা কারারুদ্ধ হইলে তাঁহাকে সেই সদস্যপদ ছাড়িতে হইবে। বিভিন্ন দল সমস্বরে বলিয়াছে, এই নির্দেশ কার্যকর হইলে পরিণাম ভয়ানক হইতে পারে। সুতরাং প্রয়োজনে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধনের উদ্যোগ হইতে পারে, যাহাতে এমন সম্ভাবনা রোধ করা যায়। দুই, কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন মত দিয়াছে যে, রাজনৈতিক দলগুলি তথ্য অধিকার আইনের আওতায় পড়ে, সুতরাং তাহাদের অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য জানিবার অধিকার নাগরিকদের আছে। এই নির্দেশটির বিরুদ্ধেও বিভিন্ন দল খড়্গহস্ত, এ ক্ষেত্রেও আইন সংশোধনের সম্ভাবনা প্রবল।
এই দুইটি নির্দেশ লইয়াই তর্ক থাকিতে পারে, বিশেষত তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত আইনটি তো সত্যই সংশোধনীয়। কিন্তু তাহা অন্য প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে যাহা লক্ষণীয়, তাহার নাম সর্বদলীয় মতৈক্য। যাঁহারা কোনও বিষয়েই এক হইতে পারেন না, তাঁহারা এই দুইটি প্রশ্নে এমন দ্রুততা এবং তৎপরতার সহিত সমস্বর হইলেন কেন? স্পষ্টতই, দুইটি ক্ষেত্রেই তাঁহাদের স্বার্থে ঘা লাগিয়াছে। দণ্ডিত বা কারারুদ্ধ জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন দলেই অল্পবিস্তর আছেন, কোনও কোনও দলে সত্যই বিস্তর। সুতরাং আদালতের নির্দেশ মানিতে হইলে ভারী বিপদে পড়িতে হইবে। আর, তথ্যের অধিকার আইন প্রযোজ্য হইলে কোন শাকের নীচ হইতে কোন মাছ বাহির হইয়া আসিবে, কে বলিতে পারে? লক্ষণীয়, তথ্যের অধিকার আইন চালু হইবার সময়ে দলগুলি প্রশ্ন তোলে নাই, এই আইনের অযৌক্তিকতার প্রতিবাদ করে নাই, বরং ‘স্বচ্ছতা’র জয়গান গাহিয়াছিল। তখন তাহারা ভাবে নাই যে, এই আইন তাহাদের উপরেও বলবৎ হইতে পারে, স্বচ্ছতার দাবি তাহাদের উদ্দেশেও নিক্ষিপ্ত হইতে পারে। এখন নিশ্চয়ই দলনেতারা মনে মনে নিজেদের অ-দূরদৃষ্টিকে দোষ দিতেছেন, ভাবিতেছেন কাচের ঘরে বাস করিলে অন্যের প্রতি লোষ্ট্র নিক্ষেপ না করাই বিধেয়। |