বিনোদন গল্প থেকে সিনেমা,
‘বই’ দেখে বই কেনার হিড়িক
ইয়ের দোকানের তাকে সামনের সারিতে উঠে এসেছে এক যুগ আগের নভেল। ‘অলীক সুখ’-এর দুই নারী রম্যাণি ও কবিতার পরিণতি নিয়ে নতুন করে নানা প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে সুচিত্রা ভট্টাচার্যকে। উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়ণের পরে বহু নতুন পাঠকই বইটির খোঁজ করছেন।
ছেলে-বুড়োর কৌতূহল মেটাতে জেরবার নবারুণ ভট্টাচার্যও। ফ্যাতাড়ু কারা? প্রবীণ দণ্ডবায়সটি আসলে কে? শত প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে লেখককে তাক করছে। ‘মালসাটে’র নবম মুদ্রণের বারো আনাই নিঃশেষ। সৃজিত মুখোপাধ্যায় ‘মিশর-রহস্য’ নিয়ে ছবি করছেন, খবরটুকু চাউর হতেই বেড়েছে বইয়ের কাটতি। অপর্ণা সেনের ‘গয়নার বাক্স’ দেখে শীর্ষেন্দুর বইটি কিনতে কলেজ স্ট্রিটে নতুন করে ভিড় বেড়েছিল। ঋত্বিক ঘটকের জীবন-আশ্রিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র পরিচালক কমলেশ্বর চট্টোপাধ্যায় তাঁর ভাবনার নেপথ্যে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘ঋত্বিকতন্ত্র’-এর কথা বলেছিলেন। ছবি নিয়ে জল্পনার আবহে কিছু প্রকাশক সেই লেখাটি ছাপাতেও নতুন করে উৎসাহ দেখাচ্ছেন।
বইপাড়ার অভিজ্ঞ প্রকাশকদের কাছে এ অবশ্য নতুন কিছু নয়। মিত্র-ঘোষের প্রবীণ কর্ণধার সবিতেন্দ্রনাথ রায় (ভানুদা) পিছিয়ে গেলেন ১৯৫২-য়। প্রবোধচন্দ্র সান্যালের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ অবলম্বনে ছবি সবে মুক্তি পেয়েছে। পাঠকদের চাহিদায় এক হপ্তায় হাজারের বেশি কপি প্রস্তুত করতে হয়েছিল। তখন অফসেট ছাপার চল ছিল না। হাতে-হাতে কম্পোজ করে, প্রুফ দেখা অমানুষিক পরিশ্রম। ভানুদা বলছিলেন, “পথের পাঁচালী ছবি হওয়ার আগেই ভাল বিক্রি হতো। ছবি হওয়ার পরে বিক্রি বেড়েছিল অবধূতের মরুতীর্থ হিংলাজের। ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ হিট করার পরে বইপাড়ার খাটনি বেড়েছিল।”
আনন্দ পাবলিশার্স-এর সুবীর মিত্রও মানছেন, সাহিত্য-আশ্রয়ী সিনেমা বরাবরই মূল বইটির পসার বাড়িয়ে দেয়। ‘মনের মানুষ’ বা ‘কালবেলা’ ছবি হওয়ার পরেও বই বিক্রির ঢল দেখা গিয়েছে। কেন এমন হয়? বিষয়টা ব্যাখ্যা করলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “এমন বহু দর্শক এখনও আছেন, যাঁদের কাছে অলীক সুখ বা কাঙাল মালসাট দু’টোই আদপে বই। এ দেশের বেশির ভাগ দর্শক এখনও একটি বই দেখতে সিনেমা হল-এ ঢোকেন। বেরিয়ে এসে তাঁরা কেউ কেউ সেই গল্পের বইটির খোঁজ করবেনই!”
শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ থেকে বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর মতো জনপ্রিয় কাহিনির ক্ষেত্রেও এই তত্ত্ব অনেকটাই সত্যি। সঞ্জয়বাবুই মনে করালেন, সে যুগে শরৎচন্দ্র-বিমল মিত্রদের সর্বভারতীয় পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে দিলীপকুমার বা গুরু দত্তের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একটি অখ্যাত পত্রিকার পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ নিয়ে সত্যজিৎ রায় সিনেমা না-করলে বইটি হয়তো অনেকেরই পড়া হয়ে উঠত না।
টালিগঞ্জে দীর্ঘদিন পর্যন্ত জমাটি সাহিত্যধর্মী গল্প ছাড়া সিনেমা হতে পারে বলেই মানা হতো না। নিউ থিয়েটার্সের রমরমার যুগে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র, সজনীকান্ত দাস, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়রাও চিত্রনাট্যের লেখক ও চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠেন। নিটোল গল্প-নির্ভর ছবিই পছন্দ ছিল উত্তমকুমারের। সত্যজিতের নায়ক-এর সুবাদে বার্লিনে গিয়ে তখনকার ইউরোপীয় ‘নিউ ওয়েভ’ ছবির স্বাদ তেমন মনে ধরেনি মহানায়কের। এ কালের নায়িকা ঋ
তুপর্ণা সেনগুপ্তর মধ্যেও গল্পে ভরপুর সিনেমার প্রতি সেই ঝোঁকটা অটুট। “সাহিত্য আশ্রয়ী ছবিতে অভিনয় করেই সব ধরনের দর্শকের স্বীকৃতি, পুরস্কার পেয়েছি। নানা ধরনের ছবি করলেও বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা এমন চরিত্রেরপ্রতি আমার আলাদা দুর্বলতা!” ‘দহন’-এর ইংরেজি ভাষান্তরের প্রচ্ছদে রমিতা তথা ঋতুপর্ণার মুখই তুলে ধরা আছে।
সিনেমার সৌজন্যে বইয়ের প্রচ্ছদ পাল্টে যাওয়ার এমন নিদর্শনও ভূরি ভূরি। হলিউডে কবেকার ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ থেকে পটার-সিরিজ বা সদ্য অস্কার মাত করা ‘লাইফ অফ পাই’ অবধি সেই ট্র্যাডিশন চলছে। চেতন ভগতের ‘দ্য থ্রি মিসটেক্স অফ মাই লাইফ’ ছবি (কাই পো চে) হওয়ার পরে বইয়ের প্রচ্ছদে ফিল্মের আলোকচিত্র (স্টিল) উঠে এসেছে। বাংলাতেও ‘সোনার কেল্লা’র প্রচ্ছদে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখা গিয়েছিল। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ ফিল্ম হওয়ার পর বিশেষ সংস্করণে প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ভিতরের পাতায় সন্দীপ রায়ের ছবির বেশ কিছু স্টিল।
শংকর বা শীর্ষেন্দু তবু বইয়ের পসারে ফিল্মি প্রভাব মানতে রাজি নন। ‘চৌরঙ্গী’র লেখক শংকরের কথায়, “আমি কিন্তু বলব, সিনেমা হলে বইয়ের ক্ষতিই হয়। পড়ার কৌতূহলটা নষ্ট হয়ে যায়।” আর ‘গয়নার বাক্স’-র লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “বিক্রি বাড়াটা সাময়িক। তাতে আখেরে বিরাট হেরফের হয় না!” তাঁর মতে, “সাহিত্য সিনেমাকে পুষ্ট করলেও, সাহিত্য বা মূল বইটির সচরাচর সিনেমা থেকে নতুন কিছু পাওয়ার থাকে না!”
চিত্রপরিচালক সুজয় ঘোষ এ কথা পুরোপুরি মানতে রাজি নন। ঋতুপর্ণের ‘ব্যোমকেশ’ মনে করাচ্ছেন, বইয়ের চরিত্র বা সময়টাকে ফিল্মে আরও বেশি রক্ত-মাংসের করে তুলতে হয়। সব বইই তো সমান চিত্রধর্মী হয় না! সুজয়ের কথায়, “বইটা পড়া না-থাকলে তো বটেই, ফিল্মের চরিত্র বা সিন দেখে আগে পড়া বইও কখনও নতুন করে পড়তে ইচ্ছে হয়। নতুন ভাবনা ও মননে সে পড়াটা তখন অন্য রকম।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.