দিদি-বোনকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে যুবক খুন
ভৌগোলিক দূরত্ব প্রায় দেড়শো কিলোমিটার। কিন্তু রবিবার ভোরে বারাসত আর দাঁইহাটের সেই ব্যবধান যেন মুছে গেল।
আড়াই বছর আগে বারাসতে দিদি রিঙ্কুকে শ্লীলতাহানির হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গিয়েছিল বছর ষোলোর রাজীব দাসের। রবিবার ভোরে কাটোয়ার দাঁইহাটে দিদি আর বোনকে নিগ্রহের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হয়ে গেলেন কুড়ি বছরের গণেশ মুর্মু। দুষ্কৃতীরা পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গণেশের বুকের বাঁ দিকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
এখানেই শেষ নয়। বারাসত আর দাঁইহাটে আরও মিল আছে। কারণ, দু’জায়গাতেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠেছে।
বারাসতের রাস্তায় ভাই রাজীবকে যখন কুপিয়ে খুন করছিল দুষ্কৃতীরা, জেলাশাসক আর অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাংলোর গেটে আর্তনাদ করেও সাড়া পাননি রিঙ্কু। আর, এ দিন দাঁইহাটে পুলিশ প্রথমে দুই তরুণীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগই নিতে চায়নি বলে গণেশের পরিবারের দাবি। নিহতের বাবাকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে স্রেফ খুনের নালিশ দায়ের করিয়ে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে কাটোয়া থানার বিরুদ্ধে।
নিহত গণেশ মুর্মু। রবিবার সকালে।
কাটোয়া শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের দাঁইহাটের পশ্চিম নসিপুর গ্রাম। সেই গ্রামে রাঙামাটি পুকুরের পাশে কয়েক বছর ধরে বাস একটি আদিবাসী পরিবারের। পুকুরের মালিক জায়গা দেওয়ায় দু’টি ঝুপড়ি তৈরি করে রয়েছেন তাঁরা। একটি ঝুপড়িতে বোন ও দিদিকে নিয়ে থাকতেন গণেশ। অন্যটিতে বাবা-মা। ওই দুই তরুণীর অভিযোগ, রবিবার ভোরে চার দুষ্কৃতী ঘরে ঢোকে। তাদের পরনে ছিল হাফপ্যান্ট, মুখ রুমালে ঢাকা। দুই বোনের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। গণেশের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি এক জনকে জাপটে ধরে ফেলেন। তখনই এক দুষ্কৃতী গুলি চালায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন গণেশ।
সকালে গণেশের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “শয়তানগুলো আগেও এক বার এসেছিল। আমার মেয়েদের উপরে অত্যাচার করবে বলে আবার এ দিন ভোরে আসে। বোনেদের বাঁচাতে গিয়ে আমার ছেলে চলে গেল।”
একই কথা বলছেন গ্রামবাসীরাও। তাঁদের বক্তব্য, কয়েক মাস আগেও চার দুষ্কৃতী একটি বাড়ির মহিলাদের উপরে চড়াও হয়। বাঁচাতে গিয়ে ছুরিবিদ্ধ হন সমীর মাঝি নামে সেই বাড়ির এক সদস্য। নসিপুরের পাশে টিকরখাঁজি গ্রামেও এক রাতে ঘরে ঢুকে দুই আদিবাসী তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। সেই সব ঘটনায় পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

শোকার্ত পরিজনেরা।
এ দিন সকালে কাটোয়া থানার পুলিশ নিহতের দেহ আনতে গেলে গ্রামের বাসিন্দারা একযোগে বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের অভিযোগ, এলাকায় আদিবাসী মহিলাদের উপরে বারবার অত্যাচার হলেও পুলিশ নিষ্ক্রিয়। শীঘ্র ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে পুলিশ তখনকার মতো মৃতদেহ কাটোয়া হাসপাতালে পাঠায়। কিন্তু হাসপাতাল থেকে নিহতের বাবা ও দুই বোনকে পুলিশ কাটোয়া থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যেতে চাইলে ফের বচসা বাধে। সিপিএম নেত্রী জয়শ্রী চট্টোপাধ্যায় পুলিশকে বলেন, “তদন্ত চাপা দেওয়ার জন্য ওঁদের নিয়ে যেতে চাইছেন আপনারা। অভিযোগ করার সময়ে আমরা সঙ্গে যাব।”
পুলিশ অবশ্য সেই দাবি না মেনে তিন জনকে নিয়ে চলে যায়। পরে গণেশের বাবা জানান, থানায় কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রাখার পরে তাঁকে একটি সাদা কাগজে সই করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। বর্ধমানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরুণ হালদার ঘটনাস্থলে গেলে তাঁকেও তিনি বলেন, “স্যার, আমাকে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছে। কী লিখেছে জানি না। একটু দেখবেন।” তরুণবাবু বলেন, “সাদা কাগজে সই করিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব।” এ দিন সকালে নিহত গণেশের দুই বোনের টিপসই করা ঘটনার বিবরণ-সহ একটি অভিযোগপত্র থানায় জমা পড়েছিল। কিন্তু দুপুরের আগে পুলিশ সেটি গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ। শেষে অবশ্য দু’টি অভিযোগ একত্র করেই মামলা শুরু হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর।

এই ঝুপড়িতেই খুন হন গণেশ। তদন্তে পুলিশ।
পুলিশের এই ভূমিকা নিয়ে দলমত নির্বিশেষে ক্ষুব্ধ এলাকার মানুষ। সিপিএমের কাটোয়া জোনাল সম্পাদক অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “সাদা কাগজে সই করিয়ে পুলিশ আসল ঘটনা আড়াল করতে চাইছিল। এলাকাবাসীর চাপে শেষ পর্যন্ত দুই বোনের অভিযোগ নেওয়া হয়।” কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “আগেও এমন ঘটেছে। অভিযুক্তেরা ধরা পড়েনি। এ বার নিহতের দুই বোনের অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা উচিত পুলিশের।” তৃণমূলের জেলা (গ্রামীণ) সহ-সভাপতি কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়েরও বক্তব্য, “পুলিশ কেন সাদা কাগজে সই করালো জানি না। তবে তদন্তে কোনও গাফিলতি বরদাস্ত করা হবে না।” রবিবার সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে কুকুর নিয়ে গিয়ে তদন্ত করে পুলিশ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের আশ্বাস, “তদন্তে কোনও গাফিলতি হবে না। আততায়ীরা শীঘ্রই ধরা পড়বে।”
এই আশ্বাসবাক্য গ্রামবাসীকে কতটা আশ্বস্ত করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গ্রামের মহিলারা বলছেন, “আগেও আমাদের উপর অত্যাচার হয়েছে। পুলিশ কিছু করেনি। এ বারেও ওরা ঘটনাটা ধামাচাপা দেওয়ারই চেষ্টা করছিল। তদন্ত আদৌ কতটা কী হবে, বুঝতে পারছি না।”
দাঁইহাটের এই ঘটনার কথা শুনেছেন বারাসতের রিঙ্কু। বললেন, “আমার ভাই খুন হওয়ার পরেও অনেক মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে দাদা-বাবা-কাকারা আক্রান্ত হচ্ছেন। আমার ভাইয়ের খুনের বিচার এখনও চলছে। খুনিরা সাজা পায়নি। ওরা সাজা পেলে হয়তো অন্য অপরাধীরা ভয় পেত।”

ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.