|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
রবীন্দ্রনাথের অন্য পরিচয় |
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ স্মৃতির ছবি (১৯০১-১৯১৪), অভীককুমার দে। পুনশ্চ, ১৫০০.০০ |
অভীককুমার দে সম্পূর্ণতই একক উদ্যোগে ও অন্বেষী নিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের যে চিত্রিত জীবনী গ্রন্থিত করবার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, বিশ্বভারতীর প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতায় ও প্রতিবন্ধকতায় সেই দায়িত্বনির্বাহ যে কতটা কঠিন হয়েছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি, প্রথম সংস্করণ, পত্রাবলি, আলোকচিত্র, চিত্রাবলি, প্রাসঙ্গিক নথিপত্রের বৃহত্তম প্রামাণ্য সংগ্রহ বিশ্বভারতীরই সম্পত্তি। অভীককুমারের সুচিন্তিত পরিকল্পনামতো তাঁরই সম্পাদনায় বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ যদি এই মহাগ্রন্থ প্রকাশ করতেন, সেটা শুধু যে সঙ্গত হত তা-ই নয়, বিশ্বভারতীরই কর্তব্য পালন হত। গত কুড়ি বছর বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ নতুন বই (রবীন্দ্রনাথের নব সংস্করণ, অনুবাদ, নবসংকলনসহ) যা প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে একটা বড় অংশ কোনও প্রকাশনা নীতি অনুসারে কী বিবেচনায় প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। অদক্ষ সম্পাদনা ও মুদ্রণভ্রান্তি তো আছেই।
বোঝা যায়, খানিকটা জেদের বশেই সুরক্ষিত লৌহদুর্গের চৌহদ্দির বাইরে থেকেই অভীককুমার তাঁর চিত্রসম্পদ আহরণ করেছেন। তাতে এক দিক থেকে হয়ত ভালই হয়েছে। বহু ব্যবহৃত, বহুলদৃষ্ট পাণ্ডুলিপিচিত্র বা আলোকচিত্রের বাইরে অনেক নতুন ‘চিত্রে’ রবীন্দ্রনাথের যেন অন্য এক পরিচয়ই এখানে মূর্ত হল। যতদূর জানি, গত বেশ কয়েক বছর বিশ্বভারতী থেকে সে ভাবে রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত সম্পদ বা উপাদান সংগ্রহে তরুণ গবেষকদের কাজে লাগানোর কেজো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। নতুন সংগ্রহ যা হয়েছে, তা দাতাদের দাক্ষিণ্যে, প্রতিষ্ঠানের আগ্রহে নয়।
তিনটি জোরের জায়গা ছিল অভীককুমারের। এক, পেশাগত ও কর্মসূত্রে তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ভারতীয় মানববিজ্ঞান সর্বেক্ষণের (অ্যানথ্রপলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া) সঙ্গে যুক্ত, তাতেই তাঁর তৈরি হয়ে গেছে বিজ্ঞানজারিত সেই অন্বেষণী প্রবৃত্তি যা সাহিত্যের অধিকাংশ ছাত্রেরই অনধিগম্য। দুই, তিনি নিজে ছবি তোলার বিদ্যায় পারঙ্গম ও দীর্ঘ দিনের চর্চায় দীক্ষিত। তিন, তিনি খুঁজে পেয়েছেন এমন অনেক অনুগ্রাহককে যাঁরা রবীন্দ্রচর্চায় বিশ্বভারতীর বাইরে রবীন্দ্রচর্চার একটা বিকল্প ধারাকে পুষ্ট করতে প্রস্তুত। তাঁদের কয়েক জনের নামও তিনি তাঁর কৃতজ্ঞতাভাজনদের তালিকায় অন্তর্গত করেছেন।
১৯০১-’১৪ কালসীমায় রবীন্দ্রজীবনের যে ঘটনাগুলিকে অভীককুমার গুরুত্ব দিয়েছেন তা হল: শান্তিনিকেতন আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও সহযোগী সমাবেশ, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘প্রবাসী’, ‘ভাণ্ডার’, ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় তাঁর ভূমিকা, ‘প্রিয়জনদের মৃত্যুর মিছিল’, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর দ্বিধাসংশয়তাড়িত সম্পর্ক, ‘জনগণমন’ কাহিনি, ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’-র প্রকাশ ও নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। চিরকুমার সভা, রাজা, অচলায়তন, চোখের বালি, নৌকাডুবি, গোরা, ডাকঘর, মালিনী, জীবনস্মৃতি, ছিন্নপত্র ও তাঁর প্রথম ম্যাকমিলান প্রকাশিত অনুবাদিত গ্রন্থমালার রচনা ও প্রকাশের নেপথ্যকাহিনির সঙ্গে সঙ্গেই স্বভাবতই অনেকগুলি কবিতা ও গানের জন্মক্ষণ ও ভাষ্য-ভাষ্যান্তরও তিনি চিহ্নিত করেছেন। দুই অংশে বিভক্ত বইটির প্রথম অংশে ছবি ও পাণ্ডুলিপির সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি, দ্বিতীয়াংশে আপাতদৃষ্টিতে যা অনুপুঙ্খ টীকা, তা কিন্তু হয়ে উঠছে রবীন্দ্রনাথের জীবনকাহিনি, তার নাটকীয়তা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রোমাঞ্চ, ক্লেশ, আনন্দ, আবেগ তথ্যসূত্র নির্দেশে তন্নিষ্ঠ থেকেও জীবনোপন্যাসের জটিল গভীরতায় প্রাণিত। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে, কখনও বা তাঁকে লেখা চিঠিতেও। এমনই অনেক চিঠি (যার অনেকগুলিই আবার বিশ্বভারতীর এখনও অসম্পূর্ণ চিঠিপত্রমালায় অপ্রাপণীয়) অভীককুমার সম্পূর্ণ তুলে দিয়েছেন।
কন্যা মীরা দেবীকে লেখা দু’টি চিঠি ও রথীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠির ধারাবাহিকতায় একটি জীবননাট্যই যেন অভিনীত হয়ে যায়। প্রথম চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ কন্যাকে উপদেশ দিচ্ছেন: ‘কায়মনোবাক্যে সতীসাধ্বী হয়ে... তোর স্বামীর জীবনে যেন তুই শক্তি, প্রীতি, পুণ্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীর মত অক্ষুণ্ণ সৌন্দর্য্যে চিরদিন বিরাজ করতে পারিস এই আমি তোকে অন্তরের সঙ্গে আশীর্ব্বাদ করি।’ (১৯০৯)। দ্বিতীয় চিঠিতে অন্য স্বর: ‘সুখের আশা রাখিস নে, মীরু— দুঃখকে ভয় করিস নে— তুই যে কোনো শাসনের ভয়ে কোনো পীড়নের দায়ে নিজের সত্যকে বিকোতে চাসনে এতে আমি সুখী— জীবন কত দিনেরই বা— সত্যই সেই জীবনকে চিরদিনের মূল্য দেয়— অসহ্য দুঃখের দ্বারাই সত্যের যাচাই হয়— তোর জীবনে তাই হোক— সফল বেদনার উপরে খাঁটি সত্যের প্রমাণ হোক।’ (১৯২১)। তারপর রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন: ‘ওর জীবনের প্রথম দণ্ড ত আমিই ওকে দিয়েছি— ভাল করে না ভেবে না বুঝে আমিই ওর বিয়ে দিয়েছি। যখন দিচ্ছিলুম তখন মনে খুব একটা উদ্বেগ এসেছিল, বিয়ের রাত্রে মীরা যখন নাবার ঘরে ঢুকছিল তখন একটা গোখরো সাপ ফস করে ফণা ধরে উঠেছিল— আজ আমার মনে হয় সে সাপ যদি তখনি ওকে কাটত তাহলে ও পরিত্রাণ পেত।’ আশীর্বাদ থেকে অভিশাপে বিবর্তনের এই ইতিহাসেই ‘স্ত্রীর পত্র’-র বীজ নিহিত।
আবার অন্য এক দিকে যেমন বিবেকানন্দ-নিবেদিতা-রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল সম্পর্কের খতিয়ান এসেছে (যার মধ্যে ভগিনী নিবেদিতাকে স্বামীজির সেই অমোঘ সতর্কবাণী, ‘তুমি যতদিন ওই (ঠাকুর) পরিবারের সঙ্গে মেলামিশি কর, আমি ওই একই কথা বলে যাব। মনে রেখো, ওই পরিবারটি সারা বাংলায় কামের বিষ ঢেলে দিয়েছে।’), তেমনই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শের রূপায়ণে নিবেদিতপ্রাণ কয়েকটি মানুষের জীবনকথা ও তাঁদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আস্থা, স্নেহ ও শ্রদ্ধার অন্তরঙ্গ পরিচয়ও উঠে এসেছে এই তালিকায় উল্লেখযোগ্য মোহিতচন্দ্র সেন, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধুশেখর শাস্ত্রী, জগদানন্দ রায়, অজিতকুমার চক্রবর্তী, সতীশচন্দ্র রায়, কালীমোহন ঘোষ, প্রতিমা দেবী। এখানে ওখানে এঁদের জীবনী হয়ত পাওয়া যাবে, কিন্তু ছবি ও চিঠিপত্রের সুগ্রন্থিত সমাবেশে তাঁরা এমন জীবন্ত হয়ে ওঠেন যে রবীন্দ্রনাথের আশেপাশে প্রথম পর্বের সহযোগীদের মধ্যে তাঁর কর্মোদ্যমের রূপরেখাটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাখি সংক্রান্তি পর্বে দুর্লভ নথিপত্রের সমাবেশ (মানচিত্র, যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি, রবীন্দ্রনাথ স্বাক্ষরিত আমন্ত্রণপত্র, শিবনাথ শাস্ত্রীর হাতের লেখায় পত্র: ‘সাদরে রাখিগাছি ধারণ করিয়াছি। ঈশ্বর করুন আপনারা যে জীবন জাগাইয়া তুলিয়াছেন, তাহার কিছু স্থায়ী ফল ফলে।’) এখনও উদ্দীপিত করে।
সর্বমতসমন্বয়ে গণতান্ত্রিক চিন্তাক্ষেত্রের বিকাশে রবীন্দ্রনাথের একটি আদি প্রয়াস ‘ভাণ্ডার’ পত্রিকার সম্পাদনা: যার প্রথম সংখ্যার সূচিপত্রে দেখি লেখকরূপে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন, বিপিনচন্দ্র পাল ও ‘সম্পাদক’ স্বয়ং, প্রশ্নোত্তর বিভাগে প্রশ্নকর্তা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তরদাতাদের মধ্যে রয়েছেন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আশুতোষ চৌধুরী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিপিনচন্দ্র পাল। সম্পাদকীয় বয়ানে রবীন্দ্রনাথের আবেদন: ‘‘কোনও ব্যক্তিবিশেষ, সম্প্রদায় বিশেষ বা সম্পাদকের মত প্রচারের উদ্দেশ্যে ‘ভাণ্ডার’ প্রকাশ করা হইতেছে না। এই পত্রে দেশের মনস্বী কৃতি ব্যক্তিত্বের মত সম্পূর্ণ অপক্ষপাতের সহিত বাহির করা হইবে, দেশের লোককে সকল মতের সকল দিক বিচার করিবার অবকাশ দেওয়াই ‘ভাণ্ডার’ প্রকাশের উদ্দেশ্য, এই কথা মনে রাখিয়া লেখকগণ অনুগ্রহ করিয়া অসঙ্কোচে নিজের মত লিপিবদ্ধ করবেন।’ ‘ভাণ্ডার’ চলেনি। আজ আর বোধহয় অমন একটা পত্রিকার কথা ভাবাও যাবে না।
অভীককুমারকে সাধুবাদ জানিয়েও দু’একটি প্রশ্ন। এক, এই অতিকায় আকারটি কি একান্তই প্রয়োজন ছিল? আর একটু ছোট করলে ছবিগুলো কি আর একটু শাণিত হত না (এমন ফেটে যেত না)? দুই, বই-পত্রপত্রিকার নাম বক্ররেখায় (ইট্যালিকস-এ) দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রকাশনরীতির স্বচ্ছতা বাঞ্ছনীয় ছিল না কি? আর বই খুলেই ‘ভূমিকা’র প্রথম পৃষ্ঠায় মুদ্রণপ্রমাদে নষ্ট ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’? |
|
|
|
|
|