বাংলাদেশের ধর্মাশ্রিত রাজনৈতিক দল জামাতে ইসলামির ভোটে দাঁড়াইবার অধিকার কাড়িয়া লইল ঢাকা হাইকোর্ট। এই দলের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা ও গণধর্ষণে জড়িত থাকার দায়ে হয় মৃত্যুদণ্ড নতুবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। দলের নবতিপর সর্বাধিনায়ক গোলাম আযম তো নব্বই বছরের কারাদণ্ড পাইয়াছেন। এখন আবার ঢাকা হাইকোর্ট ওই দলের ভোটে লড়িবার অধিকারও রদ করিয়া দিল। পরবর্তী পদক্ষেপ সম্ভবত জামাতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করা। এই মর্মে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের নানা মহল হইতে দাবি উঠিয়াছে। শাহবাগ আন্দোলনের মঞ্চ হইতেও সেই দাবির প্রবল ও ব্যাপক প্রতিধ্বনি শোনা গিয়াছে।
জামাতে ইসলামি যে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের অনেকের কাছে একটি ঘৃণিত সংগঠন, তাহাতে সংশয় নাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দলের নেতা-কর্মীদের ভূমিকাই ইহাকে জনচক্ষে ঘৃণ্য করিয়াছে। ইতিপূর্বে অন্তত তিন বার এই সংগঠন বাংলাদেশে নিষিদ্ধও হইয়াছে। কিন্তু ফৌজি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জামাতিদের উপর নিষেধাজ্ঞা রদ করেন এবং আর এক ফৌজি হুসেন মহম্মদ এরশাদ তাহাদের নির্বাচনী রাজনীতিতে টানিয়া আনেন। বর্তমানে দেশের প্রধান বিরোধী দল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি এই জামাতপন্থীদের সহযোগী। এই দুই দল কেবল একসঙ্গে নির্বাচনই লড়ে নাই, বেগম জিয়া যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন জামাতিরা তাঁহার সরকারে একাধিক মন্ত্রিত্বও হাসিল করিয়াছেন। বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অদূরেই, সেই পরিপ্রেক্ষিতে বি এন পি’র সহিত জামাতের সম্পর্ক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই দল নির্বাচনে যোগ দিতে না পারিলে বা নিষিদ্ধ হইলে বি এন পি’র ভোট-বাক্সে তাহার প্রভাব পড়িবার সম্ভাবনা প্রবল। সেই প্রভাব দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির অনুকূল হইবে বলিয়া মনে হয় না।
এই সূত্রেই একটি মৌলিক প্রশ্ন ওঠে। কোনও রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের মত পছন্দ না করিলে বা তাহাকে অন্যায় মনে করিলে নিষেধাজ্ঞাই কি যথাযথ উপায়? ইতিহাসের সাক্ষ্য ইহার বিপরীতই। দমন-পীড়ন, নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক দলকে আত্মগোপন করিতে বাধ্য করে বটে, কিন্তু নিষিদ্ধ দলের নেতা-কর্মীরা জনসাধারণের চোখে বীরের কিংবা নিহত হইলে শহিদের মর্যাদা পান। তাহাতে তাঁহাদের জনপ্রিয়তা, প্রাসঙ্গিকতা আরও বৃদ্ধি পায়। গোপনে, লোকচক্ষুর অন্তরালে, সরকারি নজরদারি ও প্রহরা এড়াইয়া নিষিদ্ধ দলটি সমাজে দ্রুত বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করিতে থাকে। দেশে দেশে বিপ্লবী কিংবা মৌলবাদী ধর্মীয় সংগঠনগুলি এ ভাবেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করিয়া শাসকদের ঘুম কাড়িয়া লইয়াছে। বাংলাদেশে জামাতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করিলেও তাহার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াইয়া দেওয়া হইবে। জামাতে ইসলামির মতামত বা ক্রিয়াকলাপের মোকাবিলা যদি করিতে হয়, তবে গণতান্ত্রিক পথেই তাহা করণীয়, সে জন্য তাহাকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করিতে দেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে জামাতপন্থীদের তত্ত্ব, মতাদর্শ ও নীতি-কর্মসূচির সহিত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রকাশ্য বিতর্ক ও আলোচনার সুযোগ থাকিবে। এ ধরনের তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা গণতন্ত্রের প্রাণস্বরূপ। ইহার সুযোগ বন্ধ হইয়া গেলে সব দিক দিয়াই স্বৈরতন্ত্র মাথা চাড়া দিতে পারে। |