ভারতের বাণিজ্যনগরী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে শূন্য হাতে ফিরায় নাই। তাঁহার ‘বেঙ্গল লিডস’ সম্মেলন অথবা দিল্লির শিল্পপতি-বৈঠক যে ভাবে শুরু এবং শেষ হইয়াছিল, মুম্বই তাহার ব্যতিক্রম প্রতিপন্ন হইয়াছে। ভারতের শিল্পমহলের বেশ কয়েক জন প্রথম সারির মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে আসিয়াছেন, তাঁহার আহ্বান শুনিয়াছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করিতে ইচ্ছার কথা জানাইয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী সমীপে ইতিবাচক মন্তব্য করা এক, আর সত্যই বিনিয়োগের ডালি হাতে রাজ্যে উপস্থিত হওয়া আর এক, তাহা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিলক্ষণ জানেন। তবু, এই বৈঠক সম্বন্ধে ইতিবাচক হওয়াই বিধেয়। পশ্চিমবঙ্গের অনেক কিছুই নাই, তবু যাহা আছে তাহা নেহাত ফেলনা নহে। এখনও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ একেবারে অন্তর্হিত হয় নাই, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি শিল্পের একটি ভিত্তি আছে, দুর্নীতি বা প্রশাসনিক অনাচারেও পশ্চিমবঙ্গ দেশে সর্বাগ্রগণ্য নহে। রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদও নিতান্ত অনুপস্থিত নহে। এবং, এই রাজ্যের পক্ষে আছে তাহার ভৌগোলিক অবস্থান। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য এবং বিহার-ওড়িশা-ছত্তীসগঢ় তো বটেই, প্রতিবেশী বাংলাদেশ, মায়ানমার এমনকী চিনের দক্ষিণ অংশের কাছেও ভারতের নিকটতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র কলিকাতা। এই গুরুত্ব দেশের বণিককুলপতিদের নজর এড়াইবার নহে। কাজেই, মুখ্যমন্ত্রী যদি শিল্পপতিদের অনুকূল পরিবেশ সম্বন্ধে আশ্বস্ত করিতে পারেন, রাজ্যে বাণিজ্যলক্ষ্মীর আসন পাকা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
কিন্তু সম্ভাবনা হইতে অর্জনের দূরত্ব বিস্তর। সেই দূরত্ব অতিক্রম করা যাইবে কি না, তাহা বহুলাংশে মুখ্যমন্ত্রীর উপর নির্ভর করিতেছে। মৌখিক আশ্বাস নহে, বাণিজ্যমহল দেখিতে চাহে, মুখ্যমন্ত্রী সত্যই রাজ্যের জমির প্রশ্নে নিজের অনড় অবস্থান ছাড়িতে রাজি কি না। শিল্পবাণিজ্য মহলের স্বাভাবিক রীতি অনুসারে অনেকেই সম্মেলনে জমি সংক্রান্ত অপ্রিয় প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন নাই। কেহ কেহ অবশ্য সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে বিকল্প জমি-নীতি গ্রহণের অনুরোধ করিয়াছেন। কিন্তু উচ্চারিত হউক বা না হউক, শিল্পায়নের পথে জমি-জট বড় সমস্যা। তদুপরি তাহার প্রতীকী মূল্য বিপুল। মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার জমি-নীতিতে অনড় থাকিলে তাহার একটিই অর্থ হয়— তিনি শিল্পের স্বার্থরক্ষায় আগ্রহী নহেন। এই মুহূর্তে অনাগ্রহের কথাটি সম্ভবত সত্য নহে। মুখ্যমন্ত্রী চাহেন, এই রাজ্যে শিল্প আসুক। তাঁহার এই মনস্কামনাটি যদি জেদের ছায়ায় ঢাকিয়া যায়, তাহা অতি দুর্ভাগ্যের হইবে। মুখ্যমন্ত্রী খোলা মনে জমির প্রসঙ্গটি পুনর্বিবেচনা করুন। তাঁহার নিকট শিল্পমহল কী চাহিতেছে তিনি জানেন। সেই চাহিদা না মিটিলে, মুখ্যমন্ত্রীর শত ইচ্ছা সত্ত্বেও, এই রাজ্যে শিল্প আসিবে না— তাহাও জানেন। অতঃপর, করণীয় একটিই— জেদ ছাড়িয়া জমির জট খুলুন।
আর একটি কথা তাঁহাকে বুঝিতে হইবে— মুম্বইয়ের বৈঠকে রাজ্যের শিল্পায়নের একটি সম্ভাব্য সূচনা হইয়াছে মাত্র। বৈঠক সফল হওয়া আর শিল্পায়নের কর্মসূচি সফল হওয়ায় বহু আলোকবর্ষের ফারাক। কাজেই, ১০০ শতাংশ সাফল্যের ঘোষণাটি আপাতত মুলতবি রাখাই বিধেয়। ছোট সাফল্যের ঝলকানিতে বড় ছবিটি যেন হারাইয়া না যায়। পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলপ্রকাশের দুই দিনের মধ্যে শিল্পমহলের সহিত এই বৈঠক একটি বিশেষ কারণে তাৎপর্যপূর্ণ হইতে পারে। এই মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের, এবং দলের, রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত। এই নিশ্চয়তা তাঁহাকে স্বভাবতই ইতিবাচক শক্তি দিবে। তিনি যদি সেই শক্তিকে শিল্পায়নের কাজে যথাযথ ভাবে ব্যবহার করিতে পারেন, যদি এই মুহূর্তটিকে অতীতের ভুল হইতে শিক্ষা লওয়ার কাজে লাগাইতে পারেন, তবে পশ্চিমবঙ্গের গতিপথ বদলাইয়া যাওয়া বিচিত্র নহে। পারিলে, এখনই পারিতে হইবে। সুযোগ আসিয়াছে। সুযোগ চিরস্থায়ী হয় না। |