কলকাতা বা তার আশেপাশের এলাকাতেই যেখানে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই, সেখানে সুন্দরবনের মতো এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা খুব খারাপ হবে, এমনটাই ধরে নেওয়া হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমা ব্লকে কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অন্তত শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ছবিটা আগাগোড়াই অন্ধকার নয়। রোগ প্রতিরোধের জন্য যে সব সরকারি পরিষেবা রয়েছে, সেগুলোর উপস্থিতি ভাল, কাজের সাফল্যও খুব খারাপ নয়। তবে সমস্যা থেকে যাচ্ছে চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে। সন্তানের জন্ম আজও সুরক্ষিত নয়। আর অসুখ হলে ভরসা সেই ডিগ্রিহীন গ্রামীণ ডাক্তার। একটি বেসরকারি সমীক্ষায় এমনই চিত্র উঠে এসেছে।
রাজস্থানের ‘ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যানেজমেন্ট রিসার্চ’ পাথরপ্রতিমা ব্লকের ১২০০ পরিবারে সমীক্ষা চালিয়ে ‘সুন্দরবনস হেলথ ওয়াচ’ রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে। দেখা যাচ্ছে, পাথরপ্রতিমায় টিকাকরণের হার বেশ ভাল। রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় গড়ে প্রায় ১৪ শতাংশ শিশুর টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয় না, এখানে কিন্তু তা মাত্র ৭ শতাংশ। এবং প্রায় সব শিশুই টিকা পাচ্ছে তাদের ঘরের কাছের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ‘সাব সেন্টার’ থেকে। উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যাও (৬৫) ব্লকের জনসংখ্যা অনুপাতে যথেষ্ট। |
মুশকিল হল, ডায়ারিয়ার চিকিৎসা এখানে হচ্ছে না বললেই চলে। এক একটা কেন্দ্রে গোটা বছরে গড়ে মাত্র ৭৪জন শিশুর চিকিৎসা হচ্ছে, যা প্রয়োজনের অতি সামান্য অংশ। ইনস্টিটিউটের প্রধান বরুণ কাঞ্জিলাল জানান, পাথরপ্রতিমায় অসুখ-বিসুখে প্রায় ৮৫ শতাংশ যাচ্ছেন হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছে। তার প্রধান কারণ এদের সংখ্যা। ব্লকের প্রায় যে কোনও জায়গায় মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে পাওয়া যায়। হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ৯০০ জনসংখ্যায় রয়েছেন একজন ‘গ্রামীণ চিকিৎসক,’ পাশ-করা ডাক্তার যেখানে ৩৫ হাজারে একজন। তবে জিআইএস ম্যাপিং করে দেখা যাচ্ছে, তিনটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের যেটি সব চাইতে ভাল কাজ করছে, সেই গদামথুরা কেন্দ্রের চারপাশের এলাকায় গ্রামীণ ডাক্তারদের সংখ্যা সব চাইতে কম। আর পূর্বে সুন্দরনগর এলাকা, যেখানে কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই, সেখানে তাঁদের সংখ্যা সর্বাধিক।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আউটপেশেন্ট বিভাগের চাইতে গ্রামীণ চিকিৎসকদের পশার অনেক বেশি, তা স্পষ্ট। রিপোর্টের পরিসংখ্যান বলছে, এই ডিগ্রিহীন চিকিৎসকদের কাছে প্রায় ২০ লক্ষ ডাক্তার প্রতি বছর যান, যেখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাচ্ছেন দেড় লক্ষের মতো। বরুণবাবু বলেন, এই গ্রামীণ চিকিৎসকরা তাঁদের আদব-কায়দায় পাশ-করা ডাক্তারদের হুবহু নকল করেন। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন, এদের চিকিৎসার মান ভাল না খারাপ। প্রশ্ন করে অবশ্য দেখা যাচ্ছে, ডায়ারিয়ার মতো সাধারণ অসুখের ক্ষেত্রেও মৌলিক প্রশ্নগুলির ভুল উত্তর দিচ্ছেন প্রায় অর্ধেক গ্রামীণ চিকিৎসক।
রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে একটি আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী, যিনি গ্রামীণ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের একটি প্রকল্প পরিচালনা করছেন। অভিজিৎবাবু বলেন, গ্রামীণ চিকিৎসকদের ভুলগুলি বাস্তবে অনেক সময়েই সরকারি ডাক্তারদের চিকিৎসার ভুলেরই প্রতিফলন। তথাকথিত ‘হাতুড়ে’ ডাক্তারদের দিকে বারবার আঙুল উঠলেও, সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তারদের চিকিৎসায় ত্রুটি এবং অবহেলা নিয়ে প্রশ্ন করা হয় না। তাঁদের দায়বদ্ধ করার কোনও উপায় নেই।
সেই সঙ্গে, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার শীর্ষ ব্যক্তিরা যে রোগের খবর পাওয়ার জন্য, এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক সময়ে এই গ্রামীণ চিকিৎসকদের উপরেই নির্ভর করেন, এ দিন আলোচনায় সে কথাও উঠে এসেছে। গ্রামীণ চিকিৎসকদের অপরিহার্যতা সত্ত্বেও, কী ভাবে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তাঁদের কতটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, সেই বিতর্কও তুললেন আলোচনায় উপস্থিত নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যরা। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে গ্রামীণ চিকিৎসা পরিষেবার দায়িত্ব দিলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে, অন্যান্য রাজ্যের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সেই সম্ভাবনার কথা বলেন প্রাক্তন পঞ্চায়েত সচিব মানবেন্দ্র নাথ রায়।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শিশুচিকিৎসার মান কেমন, সে প্রশ্নও অবশ্য উঠেছে। বরুণবাবু বলেন, সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে শিশুদের অন্য যে কোনও রোগীর মতোই দেখা হয়। শিশু রোগীর প্রয়োজনকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয় না, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেই। ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিতে মাত্র দুটি শিশুশয্যা থাকাতে অধিকাংশ শিশুদের নিয়ে হয় কাকদ্বীপ মহকুমা হাসপাতাল, নইলে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছে পরিবারগুলি।
শিশুস্বাস্থ্যের ফাঁকগুলিকে চিহ্নিত সেগুলির প্রতিকার করার চেষ্টা করবে রিপোর্ট, জানান বরুণবাবু। |