নিয়ন্ত্রণ করিবার ইচ্ছা কোনও ব্যাধি নহে, ব্যাধির উপসর্গ। মূল ব্যাধিটির নাম বাজারকে অস্বীকার করিয়া বালিতে মুখ গুঁজিয়া থাকা। ভারতীয় রাজনীতিকরা সকলেই কম-বেশি এই অসুখে আক্রান্ত। নির্বাচন আসিলেই তাহার প্রকোপ বাড়ে। এই দফাতেও যেমন বাড়িয়াছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়ামাত্র ইউ পি এ সরকার চোরাপথে সারের দাম নিয়ন্ত্রণের নীতিতে ফিরিতে প্রয়াসী। বহু অনিচ্ছা কাটাইয়া ২০১০ সালে সরকার সিদ্ধান্ত করিয়াছিল, ইউরিয়া ব্যতীত অন্যান্য সারের বাজারদর নির্ধারণের অধিকার প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে দেওয়া হইবে। তিন বৎসরমাত্র কাটিয়াছে, সেই স্বাধীনতা সরকারের আর সহিতেছে না। কেন্দ্রের সার দফতর সিদ্ধান্ত করিয়াছে, সংস্থাগুলিকে সারের দাম একটি ‘যুক্তিগ্রাহ্য স্তরে’ ধার্য করিতে হইবে। সেই স্তরটি কী হইবে, সরকার তাহাও জানাইতে বিলম্ব করে নাই। সরকারের ধার্য করিয়া দেওয়া যুক্তিগ্রাহ্য স্তরটি না মানিলে তাহা ‘অন্যায্য পথে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা’ হিসাবে বিবেচিত হইবে এবং ভর্তুকিবাবদ প্রাপ্য টাকা দেওয়া হইবে না। অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রণের সমস্ত ব্যবস্থাই পাকা।
লোকসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়িলেই কেন সারের দাম কমাইবার চেষ্টা হয়, তাহা ব্যাখ্যা করা বাহুল্যমাত্র। এই মুহূর্তে একটি পুরাতন প্রশ্ন ফিরাইয়া আনা প্রয়োজন— আদৌ সারে ভর্তুকি দেওয়া হইবে কেন? প্রথমত, সারে ভর্তুকি দেওয়ার প্রত্যক্ষ ফল প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার। তাহাতে লাভ অপেক্ষা ক্ষতির পরিমাণ যে ঢের বেশি, তাহা বহু বার প্রমাণিত হইয়াছে। দ্বিতীয়ত, সারে ভর্তুকি দেওয়া হইলে তাহার সুফলের সিংহভাগ ভোগ করেন বৃহৎ কৃষকরা। দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিবার মতো টাকা যে সরকারের নাই বলিয়া সরকারেরই এক অংশ দাবি করেন, সেই সরকার সম্পন্ন কৃষকদের এক পয়সাও ভর্তুকি দিবে কেন? পেট্রোলিয়ামে ভর্তুকি যেমন উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত তোষণ, সারের ভর্তুকিও তাহাই। রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী সুবিধা হইবে বলিয়া করদাতাদের কষ্টার্জিত পয়সায় হরির লুট দেওয়া চলিতে পারে না।
আর, ভর্তুকি যদি দিতেই হয়, তাহার কুশলীতর পন্থা ইতিমধ্যেই ভারতে চালু হইয়াছে। তাহার নাম সরাসরি নগদ হস্তান্তর। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাস হইতেই এই ব্যবস্থা চালু হইয়াছে। সব কৃষককে ভর্তুকি দেওয়ার প্রশ্ন নাই। যাঁহারা সত্যই ভর্তুকি পাইবার যোগ্য, তাঁহাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভর্তুকির অর্থ ভরিয়া দিলেই সরকারের দায়িত্ব মিটিয়া যায়। তাহার পর বাজার বুঝিয়া লইবে। আর পাঁচটি পণ্য প্রস্তুতকারক সংস্থা যখন অন্যায্য মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে না, তখন সার প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি সেই অপচেষ্টা করিবে, এমন ভাবিবার কোনও সংগত কারণ নাই। রাজনীতিকরা নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন, বাজারের প্রতিযোগিতাই তাহাদের সেই কাজ করিতে দিবে না। এই বাজার হইতে সরকার সরিয়া দাঁড়াইলে বহুবিধ লাভ। তাহাতে অযথা সার ব্যবহারের প্রবণতাটি কমিবে, রাসায়নিক সারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক সারের ব্যবহার বাড়িবে। অতএব, সরকার এই বার সরিয়া দাঁড়াইলেই অর্থনীতির মঙ্গল। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের মুখে অর্থনীতির যুক্তি আর এ দেশে কে কবে শুনিয়াছে! এখন নিজেদের ‘তোমাদেরই লোক’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিবার সময়। সরকার সেই পথেই হাঁটিতেছে। |