মুকেশ আসার প্রত্যাশা
সুশাসনের আশ্বাসই শুনতে চায় শিল্পমহল
ঞ্চায়েত ভোটের সাফল্যে প্রত্যয় আরও বাড়িয়ে বুধবার মুম্বই পাড়ি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিমানবন্দরে রওনা হওয়ার আগে বিকেলে মহাকরণে বললেন, “রাজ্যে বিনিয়োগের বার্তা দিতেই আমরা মুম্বই যাচ্ছি।” তৃণমূল সূত্র বলছে, এত দিন মমতার পাখির চোখ ছিল গ্রাম। কিন্তু তাঁর শাসনকালের দু’বছরেই শহুরে মানুষের হতাশা সৃষ্টি এবং মোহভঙ্গের প্রক্রিয়া যে শুরু হয়েছে, সেটা মুখ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ জানেন। তাই এ বার শিল্পের দিকে নজর দিতে চান তিনি।
এ কাজে হাত দেওয়ার এটাই যে উপযুক্ত সময়, সেটা বলছে সংশ্লিষ্ট মহলও। কারণ পঞ্চায়েত ভোটের ফল রাজ্যে তাঁর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে। ফলে এখন তিনি সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে প্রশাসক হয়ে উঠতেই পারেন। রাজনীতির উপরে ঠাঁই দিতে পারেন সুশাসনকে। আর সেটা যদি দেন, তা হলেই গড়ে উঠবে শিল্পের অনুকূল পরিবেশ।
বস্তুত, শিল্পমহলের মতে, গোটা দেশেই যখন মন্দার পরিস্থিতি, তখন আলাদা করে রাজ্যে লগ্নি আসা কঠিন। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে যখন সর্বার্থেই নেতিবাচক ধারণা প্রকট। অতএব লগ্নি কতটা এল, না-এল সেই ভাবনায় না গিয়ে সরকারের উচিত সুশাসনের মাধ্যমে শিল্পের অনুকূল পরিস্থিতি গড়ে তোলা। লাল ফিতের ফাঁস কাটানো। শিল্প-সমস্যা দূর করতে তৈরি কমিটিকে আরও সক্রিয় করা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে শিল্প সংস্থাকে স্থানীয় রাজনৈতিক হুমকির হাত থেকে রক্ষা করা। এ সবই আখেরে কাজে লাগবে।
বিমান থেকে নামার পর মুম্বই বিমানবন্দরের বাসে মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার। ছবি: সুমন বল্লভ।
আসলে নতুন লগ্নি তো দূরস্থান, চলতি ব্যবসাতেই রাজ্যে ভাল লোক ধরে রাখতে গিয়ে এখন হিমসিম খাচ্ছে শিল্পমহল। বিশেষ করে মেধা শিল্পে। রাজ্যের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কে এই শিল্পের কর্মীদের ধারণা একেবারেই ভাল নয়। ফলে শুধু মোটা বেতনের টানে অনেকেই এ রাজ্যে থাকতে চাইছেন না।
মুম্বইয়ে কর্মরত এক বাঙালি শীর্ষ বিমা কর্তার কথায়, “আমাদের কর্মীরা পশ্চিমবঙ্গে থাকতে চাইছেন না। প্রথমত সেখানে নতুন বড় বিনিয়োগ নেই। সেই কারণে নতুন ব্যবসা ধরা যাচ্ছে না। লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারছেন না। উন্নতি আটকে যাচ্ছে। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো তাঁদের পরিবার রাজ্য থেকে পালাতে চাইছে। শিক্ষা আর আইনশৃঙ্খলার কারণেই।” নাম তিনি দিতে চান না। পাছে নেতারা ভুল বোঝেন।
এই অবস্থায় মুম্বইতে কী লক্ষ্য হবে মমতার। এক শিল্পকর্তার সরস মন্তব্য, “১৭৭৪ সালের ১ অগস্ট জোসেফ প্রিস্টলি অক্সিজেন আবিষ্কার করেছিলেন। আর ২০১৩ সালের ১ অগস্ট রাজ্যের শিল্পের জন্য অক্সিজেনের খোঁজ করবেন মুখ্যমন্ত্রী।” সঙ্গে থাকবেন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনরা।
কিন্তু সুশাসন যদি সেই জীবনদায়ী বায়ুর একটা উপাদান হয়, অন্য উপাদান তা হলে শিল্পনীতি। এমনিতেই বিরোধী দলনেত্রী থাকার সময় থেকে শিল্পবিরোধী তকমা লেগে গিয়েছে মমতার গায়ে। সিঙ্গুর থেকে ন্যানো-বিদায় তাঁর বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড় অভিযোগ। নন্দীগ্রামেও কৃষকদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে কার্যত শিল্প-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি।
বিরোধী রাজনীতির এই উত্তরাধিকার ঝেড়ে ফেলেননি শাসক মমতা। শিল্পের জন্য তিনি জমি অধিগ্রহণ করবেন না। তুলে দেবেন না শহরে জমির ঊর্ধ্বসীমা। বড় শিল্পের বদলে ছোট ও মাঝারি শিল্পের কথাই বলবেন। অন্তত এত দিন তিনি তা-ই বলে এসেছেন।
তা হলে আশার আলো কোথায়? শিল্পমহলের একাংশ বলছে, পঞ্চায়েত ভোটের দিকে তাকিয়ে এই দু’বছর গ্রামীণ শিল্পকে আশ্বস্ত করার পথে হেঁটেছেন মমতা। এখন সেই ভোটে কেল্লা ফতে করার পরে হাতে খানিকটা হাঁফ ছাড়ার সময় আছে। এখন তিনি যে বড় শিল্পের দিকে তাকাবেন, সেই আশা করাই যায়। কারণ, বড় শিল্প না এলে যে কোষাগার ভরবে না এবং ছোট শিল্প বাঁচবে না, তা সবাই বোঝে। মুখ্যমন্ত্রী বুঝবেন না, এমনটা মনে করার কোনও কারণই নেই।
অর্থাৎ সবাই এখন রাজ্যের বাতাবরণে পরিবর্তনের প্রত্যাশী।
সেই প্রত্যাশায় ভর করে আজ বিকেল পাঁচটায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে কোন কোন শিল্পপতি হাজির হবেন, সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন। কারণ, এর আগে দু’বার ‘বেঙ্গল লিড্স’ এবং দিল্লির শিল্প সম্মেলনে হাজির হননি প্রথম সারির শিল্পপতিদের প্রায় কেউই। তৃণমূল সূত্রের অবশ্য দাবি, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে সেই সব ঘাটতি পুষিয়ে দিয়ে এ বার উপস্থিত থাকবেন রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর কর্ণধার মুকেশ অম্বানী। সংস্থার শীর্ষ আধিকারিকদের নিয়ে একটা লম্বা সময় বৈঠকে কাটাবেন তিনি।
দেশের শিল্পাকাশের অন্য নক্ষত্ররাও প্রায় সবাই নিমন্ত্রিত। যদিও শেষ পর্যন্ত কারা সাড়া দিয়েছেন, সেই তালিকা রাত পর্যন্ত অস্পষ্ট। তবে শিল্প মহলই বলছে, আজ নক্ষত্র গোনার থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা। শিল্পপতিরা যে যেখানেই থাকুন, সেই বার্তা পৌঁছে যাবে তাঁদের কাছে।
শিল্পমহলের মতে, ইতিবাচক বার্তা এবং তা রূপায়ণের রূপরেখাই হতে পারে এ রাজ্যের সফল বিপণন।
গুজরাতের হয়ে যে বিপণনটা করেছেন নরেন্দ্র মোদী। বিহারের হয়ে ভাবমূর্তি উদ্ধারের যে কাজটা করেছেন নীতীশ কুমার। আজ তাই অমর্ত্য সেন, পবন বর্মা, মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়াদের মুখে বিহারের প্রশংসা। পশ্চিমবঙ্গকে সেই সারিতে তুলে আনার তাগিদ মমতাও অনুভব করছেন বলেই রাজ্য প্রশাসন সূত্রে খবর।
বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্তের কথায়, “রাজ্যের আর্থিক হাল সবাই জানে। এই কোষাগার নিয়ে পরিকাঠামোয় কতটা কী করতে পারবে সরকার তা নিয়ে সংশয় আছেই। জমি নিয়ে সরকারের অবস্থানও অজানা নয়। মুখ্যমন্ত্রী তাই নিশ্চয়ই শিল্পের মন বুঝতে আর আশ্বাস দিতেই এই মঞ্চ ব্যবহার করবেন।” অর্থাৎ, লগ্নির স্বার্থে মমতা কতটা এগোবেন সেটা স্পষ্ট বুঝে নিতে চায় শিল্প মহল।
সি কে ধানুকা রাজ্যের শিল্পপতি। বণিকসভা ফিকি-রও অন্যতম কর্তা। তিনি হলদিয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর শিল্প মঞ্চে বেহালা বাজিয়ে এবং পরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে দাঁড়িয়ে “একলা চলো রে” গেয়ে রাতারাতি শিরোনামে চলে এসেছিলেন। তাঁর বক্তব্য, “মনে রাখবেন, আমরা এমন অবস্থায় রাজ্যে বিনিয়োগের অভাব নিয়ে সরকারের সমালোচনা করছি, যখন গোটা দেশ লগ্নির অভাবে ধুঁকছে।” তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের শিল্প সম্ভাবনা যে যথেষ্ট তা জানিয়ে ধানুকার মন্তব্য, “মাথায় রাখবেন, দেশের ২০% বাজার পূর্ব ভারতে। কলকাতা তার দরজা। পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশে রফতানিরও অন্যতম দরজা। ফলে এ রাজ্যের প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। মমতা এটাকেই অস্ত্র করে শিল্পের মন বুঝে তাঁর জমি তৈরি করবেন। তাঁর মুম্বই যাত্রার এটাই নিরিখ হওয়া উচিত।”
আসলে সবার প্রশ্ন একটাই। যে ভাবে জমি আন্দোলনের পথে ক্ষমতা জিতে নিয়েছেন, ঠিক সেই ভাবেই মুম্বইয়ে তাঁর শিল্পভাবনা নিয়ে লগ্নিকারীদের মনে মমতা নতুন জমি জিততে পারবেন কি না। আঁচ পেতে অপেক্ষা আর কয়েক ঘণ্টার।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.