হাতিশালে হাতি। ঘোড়াশালে ঘোড়া। তবু রাজার মনে সুখ নেই।
সুকুমার রায়ের গল্পে দুনিয়া ঢুঁড়ে পাওয়া গেল এক আশ্চর্য ফকিরকে। যাকে দেখে রাজা সুস্থ হলেন। আর সত্যজিতের ছবিতে গুপি-বাঘা গান ধরল, “...যার ভাণ্ডারে রাশি রাশি সোনাদানা ঠাসাঠাসি... জেনো সে-ও সুখী নয়...।” তা হলে উপায়? “এক বার ত্যাজিয়ে সোনার গদি, রাজা মাঠে নেমে যদি হাওয়া খায়, তবে রাজা শান্তি পায়!”
রাজার অসুখ না হয় সারল, পৃথিবীর অসুখ সারবে কীসে?
নিত্যনতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, পৃথিবী জুড়ে এখন বিষাদ রোগের প্রকোপ। এমনকী গত দশ বছরে ভারতের মানুষও আগের চেয়ে অনেক বেশি অসুখী হয়ে উঠেছে বলে সমীক্ষায় প্রকাশ। ব্রিটেনের ‘নিউ ইকনমিক ফাউন্ডেশন’-এর ২০১২-১৩ সালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ১৫১টি দেশের মধ্যে সুখ-সূচকে (হ্যাপি প্ল্যানেট ইনডেক্স) ভারত এখন ৩২ নম্বরে। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের চেয়েও পিছনে। বাংলাদেশ রয়েছে ১১ নম্বরে, পাকিস্তান ১৬।
তা হলে প্রথম দিকে কারা? তৃতীয় বিশ্ব যাকে সচরাচর সব পেয়েছির দেশ মনে করে, সেই আমেরিকা নয়। শিল্পবিপ্লবের ধাত্রীভূমি ব্রিটেন নয়। শক্তিধর চিন নয়। সমীক্ষা বলছে, বর্তমানে সবথেকে সুখী দেশ হল কোস্টারিকা। দ্বিতীয় ভিয়েতনাম। তৃতীয় কলম্বিয়া। চতুর্থ এল সালভাদর। কলম্বিয়ার দ্য আর্থ ইনস্টিটিউটও বিশ্ব-সুখের উপর একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে। তাতেও প্রথম ৬০টি দেশের মধ্যে ভারত নেই। |
১৫১ দেশের মধ্যে ৩২-এ ভারত |
আমি থাকি রাজার হালে, ভাল ভাল জিনিস খাই, কোন কিছুর অভাব নেই, লোকেরা সব সময় তোয়াজ করছেই
আমার হল অসুখ! আর ঐ হতভাগা ফকির, যার চাল-চুলো কিচ্ছু নেই, জামা নেই, কম্বল নেই, গাছতলায় পড়ে
তাকে, যা পায়, তাই খায় সে কিনা বলে অসুখ-টসুখ কিছু মানেই না!
রাজার অসুখ, সুকুমার রায় |
এক যে ছিল রাজা, তার ভারী দুখ।
দেখো রাজা কাঁদে রাজা বেচারা রাজার ভারী দুখ...
গুপী গাইন ও বাঘা বাইন, সত্যজিৎ রায় |
|
ফলাফল দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, অর্থনীতির উন্নয়ন কি তবে সুখের প্রধান মাপকাঠি নয়? অথচ দীর্ঘদিন ধরেই তো উদারনৈতিক এবং মার্কসবাদী, দুই শিবিরই জীবনের মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে অর্থনীতিকেই প্রধান হাতিয়ার বলে মেনে এসেছে। উদারনীতিকরা বলেছেন, অর্থনৈতিক বৃদ্ধিই আনবে উন্নয়ন। মার্কসবাদীরা বলেছেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে না পারলে কিছুই কিছু না।
কিন্তু সেই ২০০৬ সাল থেকেই নিউ ইকনমিক ফাউন্ডেশন দাবি করে আসছিল মানুষ সত্যিই গুণগত ভাবে কতটা ভাল আছে, সেটা শুধু অর্থনৈতিক বৃদ্ধিহার (জিডিপি বা গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) কিংবা মানবউন্নয়ন সূচক (হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স) দিয়ে মাপা যাবে না।
সীতারাম ইয়েচুরির মতো বামপন্থী নেতারা অবশ্য এ ধরনের সমীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সীতারাম অর্থনীতির গুরুত্বকে খাটো করতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, “মানুষের যদি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকে, মানুষ সুখী হবে কী করে? আন্দোলন ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজ বদলানোর চেষ্টাতেও সুখ থাকে। নইলে বলতেই
হবে, সুখী শূকরশাবক হওয়ার থেকে অসুখী সক্রেটিস হওয়া ঢের ভাল।”
সীতারামের তত্ত্ব অনুযায়ী, বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র কলকাতা কি তবে সুখী শহর? একটি গাড়িনির্মাতা সংস্থা ও একটি সাপ্তাহিক সংবাদ পত্রিকা ভারতের ১৬টি শহরে সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাদের রিপোর্ট বলছে, ভারতের সবথেকে সুখী শহর জয়পুর। সেখানে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ নিজেদের সুখী বলে মনে করেন। দ্বিতীয় সুখী শহর মুম্বই। তৃতীয় পটনা। আর, ‘সিটি অফ জয়’? ১৬-র মধ্যে ১৩ নম্বরে! বিশ্বে? লন্ডন-প্যারিস-নিউ ইয়র্ক নয়। হার্ভার্ডের সমীক্ষা বলেছে, বিশ্বের সবথেকে সুখী শহর ডেনমার্কের কোপেনহেগেন।
পৃথিবী জুড়েই তাবড় সমীক্ষকরা এখন একটা কথা মানছেন ক্ষমতা-প্রতিপত্তি-টাকা থাকলেই যে সুখী হয় না, এটা প্রমাণিত সত্য। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জিগমে থিনলে প্রায়শ একটা কথা বলেন, “আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য যদি সুখের শেষ কথা হত, তা হলে এই পৃথিবীতে রকফেলার থেকে শুরু করে বিল গেট্স-রাই শুধু সুখী হতেন!” থিনলে এ কথা বলেন, কারণ, ভুটান পৃথিবীর অন্যতম সুখী দেশ। ভুটান সরকারের দাবি, সে দেশের শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ নিজেদের ‘সুখী’ ভাবেন। ৪৫ ভাগ মানুষ ‘খুব সুখী’। মাত্র ৩ ভাগ লোক ‘অসুখী’। এবং এই তথ্য জিডিপি থেকে পাওয়া নয়। ১৯৭২ সালে ভুটান সরকারি ভাবে জিডিপির বদলে জাতীয় সুখ-সূচক (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস ইনডেক্স) চালু করেছে। সেখানে নাগরিকদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ, কর্মক্ষেত্রের স্বাচ্ছন্দ্য, পারিবারিক ও সামাজিক শান্তির দিকগুলোও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।
পশ্চিমের দেশগুলোও ইদানীং ভুটানের এই সুখ-মাপার আঁকজোক নিয়ে খুবই উৎসাহ দেখাচ্ছে। কারণ, বিষাদ এবং মানসিক অস্থিরতার সমস্যা ক্রমশ তাদের মাথার উপরে জেঁকে বসছে। সম্প্রতি ‘ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন’ এবং একটি মার্কিন পত্রিকা মার্কিন নাগরিকদের নিয়ে গবেষণা চালায়। ২০১৩ সালের সেই রিপোর্ট বলছে, আমেরিকার শতকরা ৩০ ভাগ লোক মানসিক উদ্বেগের শিকার। প্রতি দশ জনের এক জন হতাশা নিরোধক বড়ি খায়। ‘বাইপোলারিটি’ এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দের একটা। আত্মার উন্নতি-মার্কা বইপত্র হু হু করে বিকোচ্ছে।
সমাজ-মনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দী বলছিলেন, “গোটা বিশ্ব জুড়ে এক বিষাদ-যোগ চলছে। এটা পৃথিবীর নতুন অসুখ। লোকে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে, থেরাপি-কাউন্সেলিং করছে।” কেন এই অসুখ? আশিসবাবু মনে করেন, এখন গোটা পৃথিবী এক ধরনের নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেমে আক্রান্ত। মানুষ পাগলের মতো সুখ খুঁজছে কখনও শপিং মল-এ গিয়ে, কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেটে বুঁদ থেকে, কখনও নেশার খপ্পরে গিয়ে।
অতীতে কি তবে মানুষ বেশি সুখী ছিল? সভ্যতা ও বিজ্ঞানের বিকাশ যত হয়েছে, আমরা কি তত অসুখী হয়েছি? এই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশনের দিল্লির সচিব স্বামী শান্তাত্মানন্দ বলেন, “অতীতে ভারতের সংস্কৃতি বলেছিল, বসুধৈব কুটুম্বকম। আত্ম-পর ভেদ দূর করো। পরশ্রীকাতরতা থেকে পরার্থপরতায় পৌঁছলে তবেই সুখ ও শান্তি।” এ যুগের ঝোঁক সে দিকে নয়। প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর আক্ষেপ, “বিশ্বায়ন আমাদের বাজারে অনেক বৈচিত্র্য এনেছে। কিন্তু আমরা নিজের ভিতরে সুখ খোঁজার চাইতে বহিরঙ্গের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি।” তবে বহু চিন্তাবিদ মনে করেন, অতীতকে সব সময় বেশি সুখের বলে মনে হয়। এটাই মানুষের প্রবৃত্তি।
এই প্রবৃত্তিগুলোই বহুলাংশে মানুষের অ-সুখেরও কারণ। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, “সঞ্চয়ের প্রবণতা, অহঙ্কারবোধ, প্রতিযোগিতা ও ক্ষমতার লোভ মানুষের সহজাত। এগুলো যে তাকে আসলে সুখী করবে না, সেটাই মানুষ বুঝে উঠতে পারল না।” কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তিই যদি অ-সুখের কারণ, তা হলে মানুষ আদৌ সুখী হবে কী করে? প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে কী করে? ভুটানের জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রধান গিয়োজো শেরিং-এর কথায়, “হাতি যে ভারটা নিতে পারে, গাধা তা পারে না। এই সত্যটা বুঝে নিলেই সুখী হতে সুবিধা হবে।” চিন্তাবিদরা বলেন, সে চাবিকাঠিও মানুষের হাতেই আছে। আশিস নন্দী মনে করিয়ে দিচ্ছেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর এক রুগির মা’কে চিঠিতে লিখেছিলেন, জীবনের স্বাভাবিক দুঃখকে যে যত মেনে নিতে পারে, সে তত সুখী হয়। রবীন্দ্রনাথের গানে রয়েছে আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে, তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে..।
আর্থ-সামাজিক বৈষম্য নিশ্চয়ই বিষাদের বড় কারণ চার্লি চ্যাপলিন থেকে ঋত্বিকের ঘটকের ছবিতে তার প্রতিফলন রয়েছে কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। শুধুমাত্র আর্থসামাজিক কারণ দিয়েই যে একটি রাষ্ট্রকে সুখী বা অসুখী বলে চিহ্নিত করা যায় না, সেটা অধিকাংশ চিন্তাবিদই মেনে নিচ্ছেন। দারিদ্র আর সুখের মধ্যেকার সম্পর্ক যে সব সময়ই ব্যস্তানুপাতিক হবে, তা-ও নয়। পুওর ইকনমিক্স-এর লেখক, অধ্যাপক অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে এই সত্যই উপলব্ধি করেছেন। তাঁর কথায়, দরিদ্র মানুষও নিজের মতো করে সুখী হতে চায়, সুখী হয়। তাই সে ভাল খাবার না জুটলেও টেলিভিশন কেনে। অবস্থা ফেরানোর জন্য রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে নিজের মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যায়। মাইক্রো-ফিনান্সের সাফল্য সেখানেই।
মহাভারতে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, অ-প্রবাসে অ-ঋণে দিন কাটিয়েও যে মানুষ শেষ বেলায় শাকান্ন ভক্ষণ করতে পায়, সে-ই সুখী। অনেকেই মনে করছেন, সুখের দৌড়ে প্রথম সারির দেশগুলিকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম বা কোস্টারিকা সেটাই আবার নতুন করে প্রমাণ করল। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাই বলছেন, ভুটানের তৈরি সুখের সূচক ভারতও এ বার অনুসরণ করতে চায়। |