|
|
|
|
লড়াইটা এ বার শ্রীনিবাসন বনাম মুম্বই পুলিশ
গৌতম ভট্টাচার্য ও রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • কলকাতা |
ডিজাইনার রিপোর্ট। ক্রিকেট বোর্ড সদস্যদের ডিজাইনার প্রতিক্রিয়া। সরে যাওয়া বোর্ড প্রধানের আদর্শ প্রত্যাবর্তন মঞ্চ তৈরি। পুরো দিনটা ঠিকঠাক ছিল। ঠিক নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন যেমন চেয়েছিলেন। কেবল রাত্তিরের দিকে এসে তাঁর ‘পিকচার পারফেক্ট’ রোববারের ঈশান কোণে হঠাৎ মেঘ চলে এল।
মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রাক্তন দুই বিচারপতি জয়রাম চৌটা এবং আর বালসুব্রহ্মণ্যমকে নিয়ে তৈরি দুই সদস্যের কমিশন যে ইন্ডিয়া সিমেন্টসকে ছাড়পত্র দিয়ে দেবে, সেটা ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত সবাই জানতেন। সমস্যা বাধল, কারণ রিপোর্টে লেখা আছে মুম্বই পুলিশের অসহযোগিতার জন্য বিচারপতিরা গুরুনাথ মইয়াপ্পন নিয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। তাঁদের মনে হয়েছে, গুরুনাথ ফিক্সিং করেন না। বেটিং করেছেন কি না তা অস্বচ্ছ।
কলকাতার রোববারের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে পেশ করা ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, মুম্বই পুলিশের কাছে তথ্যপ্রমাণের জন্য বারবার আবেদন করার পরেও বিচারপতিরা কোনও সহযোগিতা পাননি। উল্টে মুম্বই পুলিশ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে কমিশনের বৈধতা নিয়েই। রাতের দিকে সংবাদমাধ্যমে যে খবর ছড়িয়ে পড়ায় আবার পাল্টা দিয়েছে মুম্বই পুলিশ। তাদের উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া আমরাই বরঞ্চ উৎসাহ দেখিয়েছিলাম। ঠিক কোন কোন তথ্য দরকার, জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু কমিশনের তরফেই উৎসাহ দেখানো হয়নি!
বোর্ডের সঙ্গে জড়িত আইনজ্ঞরা মনে করছেন, রিপোর্টের এই অংশটা বোর্ডকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলল। মুম্বই পুলিশ তো বটেই, রাতের দিকে দিল্লি পুলিশও ব্যাপারটা নিয়ে মুখ খুলেছে। পরিষ্কার বলেছে, রাজ কুন্দ্রা সম্পর্কে তারা যে তথ্য দিয়েছিল, তাতে রাজস্থান মালিকের পক্ষে ছাড়া পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল। তদন্ত কমিশন তাঁকে কী ভাবে রেহাই দিতে পারে? |
শাপমুক্তির পথে |
প্রস্থানের পথে |
|
|
|
|
শ্রীনিবাসন |
মইপ্পান |
রাজ কুন্দ্রা |
ডালমিয়া |
|
বিচারপতিদের এ দিন পেশ করা রিপোর্টে মূল অংশ চারটে:
• রাজ কুন্দ্রা।
• রাজস্থান রয়্যালস।
• গুরুনাথ মইয়াপ্পন।
• ইন্ডিয়া সিমেন্টস।
রাজ কুন্দ্রা প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হচ্ছে কেউ যদি পুলিশি হেফাজতে কোনও স্বীকারোক্তি দেন, সেটা ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী ১৬১ ধারায় পড়বে। কিন্তু সেই স্বীকারোক্তি প্রণিধানযোগ্য নয়, যতক্ষণ না তা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হুবহু দেওয়া হচ্ছে। তখন তা পড়ে যাবে ১৬৪ ধারায়। ঘটনা হল, আইপিএলে কুন্দ্রার বেটিং নিয়ে যাঁর স্বীকারোক্তিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেই উমেশ নামক বুকি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তি পেশ করার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সেটা তুলে নেন। অভিযোগ তুলে নেওয়ায় তা আইনি ভাবে প্রণিধানযোগ্য হয়নি। অতএব তার ভিত্তিতে কারও বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।
মজার কথা হল, ক্রিকেট-কর্তাদের বেকসুর ছাড় দিলেও ক্রিকেটারদের দিকে অভিযোগের তির রেখে দিয়েছেন বিচারপতিরা। স্পট-ফিক্সিং কাণ্ডে রাজস্থান রয়্যালসের জড়িয়ে পড়া নিয়ে বলা হয়েছে, পালের গোদা আসলে অজিত চাণ্ডিলা এবং অমিত সিংহ। শ্রীসন্ত আর অঙ্কিত চহ্বাণ সহায়ক ছিলেন, মূল চরিত্র নন। কিন্তু কমিশনের এ নিয়ে কিছু করার নেই, কারণ ব্যাপারটা তাদের আওতার বাইরে। সিএসকে মালিক গুরুনাথ নিয়ে বক্তব্য মুম্বই পুলিশের বিরোধিতায় ‘পাবলিক ডমেন’ থেকে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে হয়েছে। মিডিয়া রিপোর্ট, টুইটারে বিভিন্ন লোকের বক্তব্য দেখে বিচার করতে হয়েছে। অতএব গুরুনাথ দোষী কি না, তা নিয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে ইন্ডিয়া সিমেন্টস-কে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, গড়াপেটা বা বেটিংয়ের সঙ্গে কোনও ভাবেই ইন্ডিয়া সিমেন্টস জড়িত নয়।
বোর্ডের কোনও কোনও কর্তার মনে হচ্ছে, রিপোর্টে যথেষ্ট দুর্বল দিক আছে। যা নিয়ে জনস্বার্থ মামলাও করা যেতে পারে।
একাধিক বোর্ড কর্তা এ দিন আবার অসন্তোষ দেখাচ্ছিলেন যে, কোন যুক্তিতে কমিশনের রিপোর্টকে অকাট্য বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বোর্ড? কী ভাবে বলা হয়েছিল, কমিশন যা রায় দেবে, সেটাকেই চূড়ান্ত বলে ধরে নেওয়া হবে, যেখানে ইতিমধ্যেই একটা নিষ্পত্তি না হওয়া জনস্বার্থ মামলা মুলতবি রয়েছে কমিশনের বিরুদ্ধে? অকাট্য বলার অর্থ দাঁড়ায়, বিচারপতিরা রায় দিলেই শ্রীনিবাসনের জন্য রাজপথ খুলে যাবে। তাঁর বিরুদ্ধে আর কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না। |
শহরে বোর্ডের বৈঠক |
সমস্যা হল, বোর্ড সদস্যদের এই গোষ্ঠী সরাসরি বিরোধিতায় যাওয়ার অবস্থায় নেই। তাঁরা মনে করেন, চাপে থাকা সত্ত্বেও শ্রীনিই বোর্ডের ব্যালট বাক্সের বাদশা। শুধু তা-ই নয়, শ্রীনি-ঘনিষ্ঠরা রোববারের বৈঠকেই সরে যাওয়া বোর্ড প্রেসিডেন্টকে ফেরানোর চেষ্টায় নেমে পড়েছিলেন!
দুপুর দু’টো। মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে আইপিএল কমিশনার রাজীব শুক্ল (যিনি স্পট ফিক্সিং বিতর্কে ইস্তফা দিলেও তা গৃহীত হয়নি বলে জানাচ্ছেন জগমোহন ডালমিয়া) মিডিয়াকে চমকে “তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট আর আধ ঘণ্টায় পড়ছে,” বলে যাওয়ার পরপরই নানাবিধ ঘটনার শুরু। শ্রীনি-ঘনিষ্ঠরা চেয়েছিলেন, এ দিনের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের আগেই আচমকা আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের বৈঠক ডাকতে। তাতে কমিশনের রিপোর্ট প্রথমে গভর্নিং কাউন্সিল ও পরে ওয়ার্কিং কমিটিকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে শ্রীনি-র প্রত্যাবর্তনের হাইওয়ে এ দিনই মসৃণ করে ফেলা যাবে। কিন্তু অত্যন্ত কম সময়ে গভর্নিং কাউন্সিল বৈঠকের তোড়জোড় করায় সমস্ত সদস্যকে হাজির করানো যায়নি।
এই প্ল্যান ‘এ’ ব্যর্থ হওয়ায় প্ল্যান ‘বি’ সফল করতে নেমে পড়ে শ্রীনি-গোষ্ঠী। রিপোর্ট পেশ করার পরপরই বলা হতে থাকে, কথা ছিল রিপোর্ট জমা না পড়া পর্যন্ত শ্রীনিবাসন বোর্ড থেকে সরে থাকবেন। রিপোর্ট জমা পড়েছে। তা হলে এখনই শ্রীনি ফিরুন। শ্রীনি-বিরোধীরা যা শুনে আবার পাল্টা বলেন, রিপোর্টে স্বচ্ছতার অভাব দেখা যাচ্ছে। মইয়াপ্পন নির্দোষ কি না, সেটাও নিশ্চিত নয়। তা হলে কী ভাবে শ্রীনিকে ফেরানো হবে? বরং রিপোর্ট নিয়ে আগে গভর্নিং কাউন্সিল বসুক। তারা আগে অনুমোদন দিক। তার পর ওয়ার্কিং কমিটি এ নিয়ে বসবে। গভর্নিং কাউন্সিল ও ওয়ার্কিং কমিটির পরবর্তী বৈঠকের নির্ঘণ্টও ঠিক হয়ে যায় আগামী ২ অগস্ট। স্থান নয়াদিল্লি। |
শ্রীনি কথা
• লাঞ্চের ঠিক আগে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নিযুক্ত তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট পেশ করলেন সচিব সঞ্জয় পটেল।
• লাঞ্চের পর রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা শুরু। শ্রীনি ঘনিষ্ঠদের দাবি, এখনই শ্রীনিবাসনকে ফেরানো হোক। কথা ছিল যত দিন না রিপোর্ট জমা পড়ছে, তত দিন শ্রীনিবাসন সরে থাকবেন। রিপোর্ট পড়ে গিয়েছে, এ বার ফেরানো হোক।
• শ্রীনি বিরোধীদের পাল্টা বক্তব্য, রিপোর্ট জমা পড়লেও তদন্তের খুঁটিনাটি কেউ জানে না। তাই এখনই শ্রীনিবাসনকে ফেরানো ঠিক হবে না। আগে আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল ঠিক করুক, কী হবে। তার পর সেটা ওয়ার্কিং কমিটিতে পেশ করা হোক।
• তড়িঘড়ি গভর্নিং কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা হল ২ অগস্ট। একই দিনে পরবর্তী ওয়ার্কিং কমিটি মিটিং।
• শ্রীনি-ঘনিষ্ঠরা চাইছিলেন রবিবার ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠকের আগে গভর্নিং কাউন্সিলের বৈঠক করতে। চাইছিলেন সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে এ দিনই শ্রীনির প্রত্যাবর্তনের উপর সিলমোহর ফেলতে। কিন্তু সময় কম থাকায় গভর্নিং কাউন্সিলের সব সদস্যকে হাজির করানো যায়নি। প্ল্যান ভেস্তে যায়। |
পথের কাঁটা
• পুলিশের উল্টো বক্তব্য। যেখানে মুম্বই পুলিশ বলেছে, বোর্ডের তদন্ত কমিশনকে সাহায্য করতে তারা সব সময় প্রস্তুত ছিল।
• বোর্ডের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনও জনস্বার্থ মামলা।
• মিডিয়ায় শ্রীনি-বিরোধী প্রবল জনমত। |
বোর্ডের সিদ্ধান্তটা দেখলাম। আমি অত্যন্ত খুশি যে এই অপদার্থ, নির্লজ্জ সংগঠনের সঙ্গে আমি আর কোনও ভাবেই জড়িয়ে নেই।
ললিত মোদী
ঈশ্বর আছেন। আর সত্যের জয় হবেই। আমাদের পাশে দাঁড়ানো আর প্রার্থনা করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
শিল্পা শেট্টি |
|
এই সময় কারও কারও মনে হচ্ছিল, রোববার অরুণ জেটলি এলেন ঠিকই, কিন্তু সংস্কারকের ভূমিকা না নিয়ে রয়ে গেলেন স্রেফ বিশ্লেষক হয়ে। এমনও বলাবলি হতে থাকে, শ্রীনিবাসনের সদম্ভ প্রত্যাবর্তন আর মাত্র চার দিনের অপেক্ষা। কোনও কোনও কর্তা বলতে থাকেন, আজ সেটা হল না, কারণ তা হলে দায়টা পুরো ওয়ার্কিং কমিটির উপর এসে পড়ত। দিল্লিতে গভর্নিং কাউন্সিল এই রিপোর্টে অনুমোদন দিলে জেটলির দিকে কেউ আর আঙুল তুলতে পারবে না। ললিত মোদী টুইট করে দেন, ‘ভাগ্যিস আমি এই নির্লজ্জ সংগঠনের সঙ্গে নেই!’ অন্তর্বর্তিকালীন প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়াকেও ভিড়ে ঠাসা সাংবাদিক সম্মেলনে তির্যক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, ২ অগস্টে বোর্ডের বৈঠকে প্রেসিডেন্ট কে? আপনি না শ্রীনিবাসন? ডালমিয়া উত্তর দেন, “সেটা শ্রীনিবাসনকেই ঠিক করতে দিন।”
রাতের দিকে পুলিশি বক্তব্যে শ্রীনি-র প্রত্যাবর্তনের আকাশে টুকরো মেঘ তৈরি হয়েছে। কিন্তু পুরোটাই পারিপার্শ্বিকের উপর দাঁড়িয়ে। কেউ যদি নতুন করে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে। আইএস বিন্দ্রা যদি কিছু করেন। মিডিয়া যদি তীব্র শ্রীনি-বিরোধী জনমত তৈরি করে। মুশকিল হচ্ছে, পুরোটাই এখন ‘যদি’, ‘হয়তো’, ‘কিন্তু’-র জটে বন্দি! আর যতক্ষণ না এ সব ‘যদি’, ‘হয়তো’ ঘটছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দাজ করাই যায়, বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে জগমোহন ডালমিয়ার এই প্রত্যাবর্তনের মেয়াদ ২ জুন থেকে ১ অগস্ট! |
পুরনো খবর: শ্রাবণের আকাশের মতোই শ্রীনি-রিপোর্ট নিয়ে মেঘাচ্ছন্ন শহরে বোর্ডের বৈঠক |
|
|
|
|
|