সম্পাদক সমীপেষু ...
দয়া নয়, কর্তব্য
কার পেটে খিদে আর কার হাতে ক্ষমতা’ (২৪-৭) লেখাটির জন্য অমিতাভ গুপ্তকে ধন্যবাদ। সেই সঙ্গে আমার কিছু বক্তব্যও জানাতে চাই। সামগ্রিক ভাবে মিড ডে মিল বিষয়টিকে বার বার একটি বিশেষ শ্রেণির চাহিদার সঙ্গে যুক্ত করার যে প্রবণতাটি সমাজে বিদ্যমান, আমার মনে হয়, এই প্রকল্পটির হেলাফেলার পিছনে এর একটা বড় ভূমিকা আছে। ভারতে ক্ষুধা একটি বাস্তবতা এবং তা দূর করার জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতেই হবে। এবং শ্রেণিকক্ষের ক্ষুধা দূর করাটাও এর অঙ্গ। কিন্তু মিড ডে মিলকে শুধুই ক্ষুণ্ণিবৃত্তির প্রকল্প হিসেবে দেখাটা কতটা ন্যায্য? এটা তো বিদ্যালয়ের সম্পূর্ণতার একটা অঙ্গ। শিশুর পক্ষে বিদ্যালয়ই কয়েক ঘণ্টার জন্য বাড়ি। বাড়িতে থাকলে সে খাবার খেত। স্কুলেও সে খাবার খাবে। এটাই তো মিড ডে মিলের প্রধান যুক্তি হওয়া উচিত।
এ ভাবে দেখলে প্রকল্পটাকে ‘হাভাতেদের দয়া দেখানো’ থেকে মুক্ত করে সকল শিশুর বিদ্যাভ্যাসের অঙ্গ করে তোলা যায়। এটা শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত একটা ব্যাপারই নয়, এটা নিজেই একটা শিক্ষা। যা সমাজে সামূহিকতার বোধ তৈরি করে। শিক্ষা বিষয়টাই সমতার সুযোগের সঙ্গে জড়িত একটা ব্যাপার। সকলে জীবনে বিকশিত হওয়ার সমান সুযোগ পাবে, এই বোধই শিক্ষার মৌলিক দর্শন। অতএব, তার যে কোনও প্রক্রিয়াকেই ক্ষমতাধর্মী হতে হবে। দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা নিজেই একটা বিভাজন সৃষ্টিকারী উপাদান। সেখানে মিড ডে মিলকে কেবল ক্ষুধার সঙ্গে যুক্ত করার প্রবণতায় বিভাজনটা আরও পাকা হয়। পশ্চিমী মিডিয়া নিজের দেশের মিড ডে মিলকে বলে ‘স্কুল মিল’। কিন্তু ভারতের প্রকল্পটিকে বলে, ‘ফ্রি মিল’। আমরাও যদি এই চিন্তাদৈন্য দূর করতে না-পারি, তা হলে ক্ষতি আমাদেরই। গরিব, বড়লোক নির্বিশেষে। অতএব দাক্ষিণ্য নয়, বিষয়টাকে অধিকার ও কর্তব্য হিসেবেই দেখতে হবে। অধিকারটা সকল শিশুর। কর্তব্যটা রাষ্ট্র ও সকল নাগরিকের।
আমরা কেউই কিন্তু ‘সেফ জোন’-এ নেই
আমাদের সমাজে মানসিক ভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করার ও তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করার রেওয়াজ যুগ যুগ ধরে চলছে। কারণ, আমাদের দৃষ্টিতে তারা ‘পরিপূর্ণ মানুষ’ নয়। তাই তাদের নিয়ে যে কোনও রকম মজা করা ও হেসে গড়িয়ে পড়াটা আমাদের ‘মানবাধিকার’-এর মধ্যেই পড়ে। কারণ, আমরা তো মানুষ, আমরা তো ওদের মতো নই।
সাম্প্রতিক একটি টিভি অনুষ্ঠান আমাদের এই কদর্য আমোদ-আহ্লাদের এক উদাহরণ। একটি এপিসোডে তথাকথিত শিল্পীরা ‘পাগল’-দের আচার-আচরণ অনুকরণ করার উল্লাসে মেতে উঠেছেন। আর তাই দেখে হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যাচ্ছে।
যাঁরা এই মজায় মজে আছেন তাঁদের সবিনয় জানাই যে, বর্তমান সমাজে আমরা কিন্তু কেউই ‘সেফ জোন’-এ নেই। যে কোনও সময় আমরা যেমন ভাইরাল ফিভার, ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস-এর মতো রোগে আক্রান্ত হতে পারি-- সে রকম ভাবেই আমরা যে কেউ, যে কোনও মানসিক অসুস্থতারও শিকার হতে পারি। তাই এই ধরনের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের অর্থ মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের অমানবিক ভাবে ‘স্টিগমাটাইজ’ করে তাদের মানবাধিকারকে নিষ্ঠুর ভাবে লঙ্ঘন করা। মানসিক রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে আতঙ্কজনক বার্তা জনমানসে প্রচার করা সমর্থনযোগ্য নয়।
পরিষেবার মানসিকতা
এ কথা ঠিক যে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় (চিকিৎসা ব্যবস্থা সমেত) যথোপযুক্ত পরিকাঠামো ও উপকরণ চাই (‘স্বাস্থ্য ব্যাপারটা আর একটু জটিল’, সজল বিশ্বাসের চিঠি ও স্বাতী ভট্টাচার্যের উত্তর, ১৭/৭) কিন্তু আমার চিকিৎসক জীবনের অভিজ্ঞতায় মনে হয়, তার চাইতেও বেশি দরকার পরিষেবা দেওয়ার উপযুক্ত মনোভাবাপন্ন কর্মিবৃন্দ (ডাক্তার, নার্স ও অন্য কর্মী)। বর্তমানে বেশ কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভাল বাড়ি হয়েছে, বেশ কিছু উন্নত যন্ত্রপাতি বসেছে, কিন্তু এ সব যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, অর্থাৎ রোগীর চিকিৎসা করা সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতে যে আন্তরিকতা দরকার তা নেই। শুধু যন্ত্র সব কাজ করতে পারে না।
আমাদের দেশের গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ডাক্তারদের হাজিরার (৪২ শতাংশ) করুণ চিত্র এবং রোগী দেখার আন্তরিকতার অভাব যে সব গবেষণায় ফুটে উঠেছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলেই শহরের টার্শিয়ারি হাসপাতালগুলিতে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হচ্ছে। উপরোক্ত গবেষণার পর্যবেক্ষণগুলি সমস্যার গভীরে ঢুকে তার বাস্তব সমাধান করতে সাহায্য করতে পারে। সরকারি চাকরিটা এখন ডাক্তারদের (অনেকাংশের) কাছে নিশ্চিত ভাল মাইনের আয় আর প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে রোগী টানার যোগাযোগের মাধ্যম মাত্র। অন্য শ্রেণির কর্মীর কাছেও বর্তমানের নিশ্চিত আয় আর ভবিষ্যতের পেনশনের গ্যারান্টি। যদি মানসিকতা না গড়ে ওঠে, তা হলে যতই হাসপাতাল, সরঞ্জাম, ডাক্তার সরকারি ব্যবস্থায় বাড়ানো হোক না কেন, এই মিশ্র অর্থনীতির দেশে তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু যদি সরকারি ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে ক্রমশ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়া হয়, তা হবে আরও গর্হিত কাজ। শুধু সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা কেন, কর্পোরেট হাসপাতাল বা প্রাইভেট প্র্যাক্টিসেও যে নৈরাজ্য চলছে তাতে ডাক্তারির মতো ‘মহান’ পেশার মহত্ত্ব আর থাকছে না।
সচেতন মানুষের উচিত হবে ছোট ছোট ক্ষেত্রে ভাল মানুষ হওয়ার আন্দোলন গড়ে তোলা। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়রা সম্ভবত সেই ধরনের কিছু কাজ শুরু করেছেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.