সরকারের বা প্রশাসনের যে কাজ করার কথা, তাহা যখন আদালতকে করিয়া দিতে হয়, তখন সরকার থাকার প্রয়োজনীয়তা লইয়াই প্রশ্ন উঠিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে প্রতি দিন যাহা ঘটিয়া চলিয়াছে, তাহাতে এমন প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। সরকারি বিভিন্ন দফতর ও মন্ত্রকের নিষ্ক্রিয়তা কিংবা উদ্যমহীনতার প্রতিবিধান চাহিয়া নিত্য আদালতে বিভিন্ন আর্জি পেশ হইতেছে। নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগের বৃহদংশই আসিতেছে পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। কখনও শাসক দলের অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে নিয়মমাফিক ব্যবস্থা লইতে গড়িমসির অভিযোগ, কখনও বা পদ্ধতিগত খুঁটিনাটির প্রশ্ন তুলিয়া অভিযোগকারীর সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নস্যাৎ করিবার অভিযোগ। জেলা কিংবা ব্লক স্তরে যখন এই সব কাণ্ড ঘটিতেছে, তখন মন্ত্রক স্তর হইতে বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থার সহিত অসহযোগিতার সংকেত মিলিতেছে। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচন কমিশনের সহিত অসহযোগিতার পর এখন পুরসভা ভোটগ্রহণের দিনক্ষণ নির্ধারণে আদালতকে হস্তক্ষেপ করিতে হইয়াছে।
বীরভূম জেলার শাসক দলের সভাপতির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ পাইয়াও পুলিশ যখন সে জন্য আদালতের অনুমতি চাহিবার অজুহাতে কালক্ষেপ করে, তখন আদালত স্পষ্টই ভর্ৎসনা করে, এই অজুহাত অর্থহীন। একই ভাবে রাজ্যের ১৭টি পুরসভার মেয়াদ ফুরাইবার আগে হইতেই রাজ্য নির্বাচন কমিশন সতর্ক করিলেও পুর মন্ত্রকের বিরুদ্ধে নির্বাচনের নির্ঘণ্ট লইয়া টালবাহানার অভিযোগ শোনা গিয়াছে, পছন্দসই প্রশাসক বসানোর অভিসন্ধিতেই এই টালবাহানা চলিতেছে, এমন কথাও উঠিয়াছে। এই প্রশ্নেও নির্বাচন কমিশনকে মান্যতা দিয়া সরকারকে তাহার সুপারিশ শিরোধার্য করার নির্দেশ দিয়াছে আদালত। এমন কথা মনে করিবার কারণ নাই যে, সরকারের কর্ণধার ও প্রশাসনের আধিকারিকরা শাসনপ্রণালীর এই সব দিক সম্পর্কে অবগত নন। কিন্তু অনুমান করা যায়, মন্ত্রীরা নিজেদের জেদ বজায় রাখিতে সাংবিধানিক রীতিপদ্ধতি উল্লঙ্ঘন করিতেছেন। দেখাদেখি জেলা ও ব্লক স্তরের প্রশাসনও শাসন পরিচালনার স্বীকৃত পদ্ধতি এড়াইয়া নেতৃত্বের মন রাখিয়া চলিতে তৎপর। বিশেষত, দুষ্কৃতী দমন করার প্রশ্নে লক্ষ করা যাইতেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশ জামিনযোগ্য লঘু ধারায় অভিযোগ সাজাইয়া শাসক-আশ্রিত সমাজবিরোধীদের অব্যাহতির ব্যবস্থা রাখিয়া দিতেছে। সিআইডি-র তদন্তেও একই প্রবণতা। জেলার পুলিশ সুপাররা ধর্ষককে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিবার পরিবর্তে ধর্ষিত ও নিহত গৃহবধূর চরিত্রের শংসাপত্র লিখিতে অধিকতর মনোযোগী, যেন সমাজ তাঁহাদের কাছে এমন শংসাপত্র দাবি করিয়াছে।
এ সবই প্রশাসনকে তাহার ধর্ম হইতে বিচ্যুত করিয়া আইনের শাসনে অন্তর্ঘাত চালাইবার পথ সুগম করিতেছে। সন্দেহ নাই, এই প্রবণতারও সূচনা বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই। প্রশাসন ও সরকারের বিভিন্ন দফতরকে নিষ্ক্রিয় করিয়া রাখিয়া রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অভিপ্রায় অনুযায়ী চালনার প্রক্রিয়াটি তখনই শুরু হয়। কিন্তু গত দুই বছরে সেই অনৈতিক ও অস্বাস্থ্যকর প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। যে ভাবে প্রতিদিন একের পর এক ঘটনায় রাজ্যের গ্রামে-গঞ্জে প্রশাসনকে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের অনুগামী হইয়া ঘুরিতে দেখা যাইতেছে, তাহাতে জনসাধারণের মনে এক নিরুপায় অসহায়তাই বাসা বাধিতেছে। এখনই তাহার প্রতিফলন হয়তো ব্যালটে দেখা যাইবে না, কিন্তু শাসকেরা নিজেদের সংশোধন না করিলে, প্রশাসনকে তাহার কাজ দল-নিরপেক্ষ ভাবে করিতে না দিলে, হতাশ জনগণই একসময় মরিয়া হইবেন। দুই বছর আগে যেমন হইয়াছিলেন। |