অবশেষে বাজারজনিত ঝুঁকি গ্রাস করল বন্ডের বাজারকেও। এত কাল সবাই জানতেন শেয়ারই হল ঝুঁকির রাজা। বন্ডে অল্পবিস্তর ঝুঁকি থাকলেও মানুষ তা খুব একটা প্রত্যক্ষ করেননি। এই কারণে সাধারণ মানুষ শেয়ার ও বন্ডের মধ্যে বন্ডকেই বেছে নিতেন। এঁদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল বন্ড ফান্ড এবং ইনকাম ফান্ড। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে বন্ডের বাজারে যে-সুনামি দেখা দিল, তাতে বন্ডের উপর হয়তো আর আগের মতো আস্থা রাখা যাবে না। গোড়া থেকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যাক।
|
বন্ড হল এক ধরনের ঋণপত্র। সরকার নিজে এবং বহু সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা বন্ড ইস্যু করে বাজার থেকে ঋণ সংগ্রহ করে। বন্ড একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের হয় এবং এর উপর প্রদেয় সুদের হার ইস্যুর সময়ে বলে দেওয়া হয়। বন্ডের রেটিং দেখে আনুমান করা যায়, একটি বন্ড কতটা সুরক্ষিত। সরকারি বন্ডকে ছোট করে ‘গিল্ট’ বলা হয়। অনেক বন্ড শেয়ার বাজারের ঋণপত্র বিভাগে নথিবদ্ধ করা হয়। এতে যখন খুশি কেনা এবং বিক্রি করার সুযোগ মেলে। বন্ড ইস্যুর সময়ে সরাসরি ইস্যুকারী সংস্থার কাছ থেকে অথবা পরে বাজার থেকে কেনা যেতে পারে। চাহিদা, জোগান এবং প্রচলিত সুদের হারের পরিবর্তন অনুযায়ী বন্ডের দাম ওঠা-নামা করে। তবে বন্ডের বাজার কোনও কালেই শেয়ার বাজারের মতো উত্তাল ছিল না। এ বার কিন্তু বড় রকমের স্পন্দন দেখা দিয়েছে এই শান্ত দুনিয়ায়।
মিউচুয়াল ফান্ডে সংগৃহীত তহবিলের একটি বড় অংশ লগ্নি করা হয় বন্ডে। যে-প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থ বন্ডে লগ্নি করা হয়, তাকে বলা হয় বন্ড ফান্ড অথবা ইনকাম ফান্ড। মিউচুয়াল ফান্ডের অধীনে মাসিক আয় প্রকল্পগুলি আসলে বন্ড ফান্ড। ব্যালান্সড ফান্ডেরও একটি বড় অংশ লগ্নি করা হয় বন্ড অর্থাৎ ঋণপত্রে। ঝুঁকি যাঁদের কম পছন্দ, তাঁদের অনেকেই বন্ড ফান্ডকে ইক্যুইটি ফান্ডের তুলনায় বেশি পছন্দ করেন। |
বন্ডে যেমন ঝুঁকি কম, তেমন কম হঠাৎ বড় লাভের সম্ভাবনাও। কোনও সংস্থা থেকে সরাসরি বন্ড কিনলে এবং তা বাজারে বিক্রি না-করে মেয়াদ শেষে ওই সংস্থা থেকে মূল টাকা ফেরত নিলে বাজারজনিত ঝুঁকির আঁচ খুব একটা গায়ে লাগে না। তবে বন্ড ফান্ডে লগ্নির ক্ষেত্রে এই ঝুঁকির কারণে ডিভিডেন্ডের তারতম্য হতে পারে।
গত কয়েক বছর ধরে ইক্যুইটির দুর্দিনে বড় রকমের চাহিদা বৃদ্ধি হয়েছিল ঋণপত্র-নির্ভর অসংখ্য প্রকল্পের। মানুষও এখানে টাকা রেখে বেশ নিশ্চিন্তে ছিলেন। সে বিশ্বাসে এ বার ধাক্কা লাগল বন্ডের বড় পতনে। এই আস্থা ফিরে আসতে কিন্তু অনেক সময় লাগবে। সাধারণত ঝুঁকি বিমুখ মানুষেরাই বিশেষ করে লগ্নি করেন ঋণপত্রে। এ বারের লোকসান বড় রকমের চিড় ধরাবে এঁদের আস্থায়। সাবধানী মানুষেরা হয়তো আবার ফিরবেন সনাতন ডাকঘর এবং ব্যাঙ্ক জমা প্রকল্পে।
|
বাজারে প্রচলিত সুদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক আছে বন্ডের। তবে এদের গতি বিপরীতমুখী। ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়ালে বাজারে বন্ডের দাম কমে। উল্টোটা হয় সুদের হার কমলে। সুদের ওঠা-পড়ার সঙ্গে বন্ড তার প্রকৃত আয়কে (ইল্ড) সব সময়েই মানানসই (অ্যাডজাস্ট) করে নেয়। যেমন ধরা যাক, ব্যাঙ্ক সুদ এবং বন্ডের ইল্ড দুই-ই এখন ৮ শতাংশ। এবং বন্ডের বাজার দর ১০০ টাকা। ব্যাঙ্ক সুদ যদি কমে ৭.৫ শতাংশ হয়, তবে বন্ডের দাম বেড়ে হতে পারে ১০৬.৬৬ টাকা। অর্থাৎ বন্ডে লগ্নি করতে হলে সব সময়ে প্রচলিত সুদের গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখতে হবে। সুদের ওঠা-নামার কারণে বন্ডের বাজারজনিত ঝুঁকি কমবেশি থাকে।
|
এ বারের বড় পতন অবাক করে দিয়েছে সবাইকে। শুধু বড় মেয়াদের ঋণপত্রই নয়, পতন হয়েছে এমনকী খুব ছোট মেয়াদি এবং লিক্যুইড প্রকল্পগুলিরও। পতনের যে-সব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলি সঙ্গের সারণিতে দেওয়া হল।
|
ঋণপত্রের বাজার দর পড়েই চলেছে। টাকার মূল্য পতন রুখতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সম্প্রতি যত পদক্ষেপ করেছে, তার সবগুলিরই প্রতিকূল প্রভাব পড়েছে বন্ডের বাজারে। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এই সব ব্যবস্থা স্বল্পমেয়াদি। তবে রাতারাতি অবস্থা পাল্টাবে না। আরও বেশ কিছু সময় লাগতে পারে। অনেকটাই নির্ভর করবে সরকার এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আগামী দিনে কী সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিদেশি লগ্নিকারীরা বন্ডের বাজারে ফিরে আসে কি না, তার উপর। বন্ডের মূল্য পতনে বড় রকমের লোকসানের সামনে পড়েছে ব্যাঙ্ক এবং বিমা কোম্পানিগুলি। আঘাত পাবে ঝণপত্র নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ড প্রকল্প এবং অনেক ইউলিপ প্রকল্প। খুব দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আজকের জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে না। চাকা ঘুরলে প্রথমে পালে হাওয়া পাবে স্বল্পমেয়াদি ঋণপত্রগুলি। বড় মেয়াদের বন্ডের ক্ষেত্রে হয়তো এই দুর্যোগ আরও কিছু দিন চলবে।
|
শেয়ার এবং বন্ড এই দুই বাজারেই এখন পা ফেলতে হবে অতি সাবধানে। বিপদ এখন পদে পদে। বাজার থেকে এখন ঋণপত্র কেনাবেচা বন্ধ রাখলেই ভাল। আপাতত এড়িয়ে চলতে হবে দীঘর্র্মেয়াদি ঋণপত্র। বন্ড সরাসরি কেনা যেতে পারে ইস্যুকারী সংস্থার কাছ থেকে। ঋণপত্র নির্ভর ফান্ড থেকে ছোট মেয়াদে ডিভিডেন্ড পাওয়ার সম্ভাবনা কম। নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ বাজারে দেখা পাওয়া যেতে পারে করমুক্ত বন্ড ইস্যুর। অপেক্ষা করা যেতে পারে তার জন্য। বন্ডের এই পতনে এবং শেয়ার বাজারের অস্থিরতার কারণে বড় ধাক্কা পৌঁছবে মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পে। একই সঙ্গে দুই বাজারের এমন খারাপ অবস্থা অতীতে কমই হয়েছে। |