চারমিনার ওঁর মগজাস্ত্রকে ধারালো করে! তা ছাড়া ‘ও ভাল ক্রিকেট জানে, প্রায় একশো রকম ইন্ডোর গেমস বা ঘরে বসে খেলা জানে, তাসের ম্যাজিক জানে, একটু একটু হিপনোটিজম জানে,
ডান হাত আর বাঁ হাত দু’হাতেই লিখতে জানে...’।
এই বহুমুখী প্রতিভাবান কে, সেই উত্তরের জন্য কোনও পুরস্কার নেই। নয় নয় করে আটচল্লিশ বছর পার করে দিলেন প্রদোষ মিত্তির। ঠাকুর্দার হাতে গড়া ‘সন্দেশ’কে ফের জাগিয়ে তুলতে যাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
কিংবদন্তি বাঙালি গোয়েন্দাকে নিয়ে এ বার সর্বভারতীয় দর্শকের জন্য একটি তথ্যচিত্রের কাজ শুরু হয়েছে। একাধিক ছবিতে সন্দীপ রায়ের সহকারী পরিচালক সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায় এটি পরিচালনা করছেন। ঠিক আছে, ২০১৫ সালে ফেলুদার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে কাহিনিচিত্রের ধাঁচেই দেশের বিভিন্ন হল-এ মুক্তি পাবে তথ্যচিত্রটি। তার আগে আগামী বছর এই ফেলু-চরিত দেখানো হবে আমস্টারডামের আন্তর্জাতিক তথ্যচিত্র উৎসব, কান ও টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে। |
তথ্যচিত্রের শুটিংয়ে সন্দীপ রায়। ছবি: সৌরদীপ রায়। |
শার্লক হোমসকে নিয়ে একাধিক তথ্যচিত্র রয়েছে। টিনটিনকে (যদিও সে ঠিক গোয়েন্দা নয়) নিয়ে রয়েছে আস্ত মিউজিয়াম। কিন্তু কোনও উপন্যাসের চরিত্রকে নিয়ে পুরোদস্তুর তথ্যচিত্র পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, ভারতেও এই প্রথম। “বেশ কয়েক বছর ধরেই আইডিয়াটা মাথায় ছিল,” জানাচ্ছেন সাগ্নিক। এমনিতে তিনি কর্পোরেট ও অ্যাড ফিল্ম পরিচালক। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’তে প্রথম কাজ সন্দীপের সঙ্গে। তার পর ‘নিশিযাপন’ থেকে সন্দীপের সহকারী পরিচালক।
আজকের দিনে ফেলুদাকে ঘিরে আর নতুন কী দেওয়া সম্ভব দর্শককে? ফেলুর অভিযানের কাহিনিচিত্র তো রয়েইছে, তার ওপর প্রতিটা বই থেকে ফেলু-তোপসে-লালমোহনের বিশেষ বিশেষ কথোপকথন মুখস্থ বলে দিতে পারেন কোনও কোনও ভক্ত। সাগ্নিকও দীর্ঘদিন রায়বাড়ির সান্নিধ্যে থাকার সুবাদে ফেলুদাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। বললেন, “প্রথমত, একেবারে নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্যচিত্রটি বানানো হচ্ছে। ফেলুদা কী করে ফেলুদা হল, সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা হবে আজকের ‘জেন এক্স’-এর কাছে। দ্বিতীয়ত, ভিন্ রাজ্যে পড়াশোনার সুবাদে দেখেছি, ফেলুদার অবাঙালি ফ্যানের সংখ্যা বিশাল। কিন্তু তাঁদের কাছেও সত্যজিতের লেখক সত্তার অনেকটাই অজানা। ইংরেজি ভাষায় এই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে সেটাও তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।”
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এ ছবির প্রযোজনা করতে পরম আগ্রহে যিনি এগিয়ে এসেছেন, তিনি গুজরাতি। ‘কালাশ এন্টারটেনমেন্ট’-এর কর্ণধার এই রিচার্ড পিটার্স আদ্যন্ত ফেলুদা ভক্ত। এর আগে ‘লাইফ অব পাইয়ের’ মত বড় প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। বললেন, “অনুবাদে পুরো ফেলুদাই প্রায় পড়েছি। ছবিও দেখেছি। এর জনপ্রিয়তার কথা জানা। এই প্রকল্পে যুক্ত হতে পেরে আমি উৎসাহিত।”
সন্দীপ রায় গোড়া থেকেই সাহায্য করছেন। ‘রে সোসাইটির’ (যার সচিব সন্দীপ) ভাণ্ডার খুলে দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার দুষ্প্রাপ্য ছবি, ফুটেজ, পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড থেকে কেনা সেই হার্ড কভারের খাতা (গোড়া থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ফেলুদার খসড়া রয়েছে যাতে) কী নেই সেখানে? সেই সব দুষ্প্রাপ্য দলিল, বিজ্ঞাপনে ও বইয়ের জ্যাকেটে ফেলুদা, অজস্র খসড়া, পেন্সিল ড্রইং, শ্যুটিং-এর ফুটেজ সবই দেখানো হবে তথ্যচিত্রে। যে সব জায়গায় রহস্য সন্ধানে গিয়েছে ফেলুদা, ক্যামেরা দৌড়াবে সেখানেও।
সন্দীপ রায় বললেন, “ফেলুদার ক্যারিশমা এখনও শুধু অটুটই নয়, ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আর শুধু ফেলুদা নয়, গোয়েন্দা নিয়েই ছবি করার, ফিরে দেখার একটা ধুম পড়ে গিয়েছে। তবে এমন একটা সময়ও মাঝে ছিল যে, ফেলুদার ছবি করার জন্য টানা ২৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল আমায়। কোনও প্রযোজক এগিয়ে আসেননি।” ফেলুদার তথ্যচিত্রটি নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী তিনি, যদিও নিজে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত থাকতে চাইছেন না। জানালেন, “সাগ্নিকই প্রথম এই ভাবনাটা নিয়ে আসে। তাই ও স্বাধীন ভাবে কাজ করুক, এটাই চাইছি।” সন্দীপ-পুত্র সৌরদীপ অবশ্য এই প্রকল্পে জড়িয়ে পড়েছেন।
যেমন জড়িয়ে পড়েছেন ফেলু-ভক্ত অভিনেতা রজতাভ দত্ত। প্রবল উত্তেজিত তিনি বললেন, “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দরকারি কাজ। তৃতীয় প্রজন্ম ফেলুদাকে নিয়ে কাজ করছে এটাও একটা দারুণ ব্যাপার। টেলিভিশন, গ্রাফিক নভেল, বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি ভাষায় অনুবাদসব হয়েছে ফেলুদাকে নিয়ে। একটি সামগ্রিক তথ্যচিত্রের খুবই প্রয়োজন ছিল।” রজতাভ মনে করেন, আজকের প্রজন্ম ঘনাদা-টেনিদাদের দেখে পিরিয়ড পিস হিসেবে। কিন্তু ফেলুদা সবসময়ই সমসাময়িক।
ইংরেজি, ফরাসি, জাপানির মত বিদেশি ভাষাতে তো বটেই, হিন্দি, গুজরাতি, ওড়িয়া, মালয়ালম, মরাঠি— এই পাঁচটি ভারতীয় ভাষায় এখনও পর্যন্ত অনুবাদ হয়েছে ফেলুদা-কাহিনি। ফেলুদার এই ‘সর্বভারতীয়’ মুখটিকেই তুলে ধরতে চাইছেন সাগ্নিক। জানালেন, ফেলুদা যে শুধুমাত্র বন্দুক চালানো ডিটেকটিভ নন, কালক্রমে কেন তিনি সামাজিক হিরো হয়ে উঠলেন, সেই দিকটা নিয়ে ফেলুদা-গবেষকরা তো বটেই, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষেরাও কথা বলবেন এই ছবিতে। বলবেন বিভিন্ন প্রদেশের আম ফেলু-ভক্তরা। মূল ভাষ্য ইংরেজিতে হলেও বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় সাক্ষাৎকারগুলি থাকবে সাবটাইটেল-সহ।
এ ছাড়া থাকবে বলিউড, টলিউড এমনকী দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিরও বিভিন্ন নামজাদা ‘ফেলুদা-ভক্তের’ সাক্ষাৎকার। শোনা যাচ্ছে, এই তালিকায় থাকতে পারেন অমিতাভ বচ্চনও! টিভিতে ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস’ সিরিজে শশী কপূরের বদলে তাঁরই তো প্রথম হিন্দিভাষী ফেলুদা হওয়ার কথা ছিল! |