নির্বাচন কমিশন-রাজ্য চাপানউতোর, আইন-আদালত, সন্ত্রাসের অভিযোগ ঘিরে শাসক-বিরোধী টানাপোড়েন, খুন-জখম-হাঙ্গামা পেরিয়ে এসে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আজ শেষ অঙ্ক। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে আগামী পাঁচ বছর ক্ষমতায় কারা, তার অনেকটাই নির্ধারণ হয়ে যাব আজ, সোমবার।
ভোট গণনার দিন গোলমালের আশঙ্কায় সব রাজনৈতিক দলকে বিজয় মিছিল করতে নিষেধ করল জেলা প্রশাসন। জেলাশাসক তথা বর্ধমানের নির্বাচন আধিকারিক ওঙ্কার সিংহ মিনা বলেন, “সোমবার পুলিশের বড় অংশ গণনাকেন্দ্রেই কাজে ব্যস্ত থাকবে। তাই কোথাও বিজয় মিছিল করার অনুমতি পুলিশ দেবে না।”
২৭৭টি পঞ্চায়েত, ৩১টি পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের ৭৫টি আসনের গণনা হবে আজ, সোমবার। ২০০৮ সালে বামেরা ২০২টি ও কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ৬৩টি পঞ্চায়েত দখল করেছিল। বিজেপি, নির্দল ও অন্যেরা ক্ষমতায় এসেছিল বাকি ১২টিতে। ৩১টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ২৬টি পায় বামেরা। চারটি তৃণমূল এবং একটিতে কংগ্রেস ক্ষমতা দখল করে। জেলা পরিষদে তিনটি আসন ছাড়া বাকি সব ক’টিতেই জিতেছিলেন বামফ্রন্টের প্রার্থীরা। |
এ বার ২২৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট ৪০৬৭টির মধ্যে ৮১১টি আসনে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। তার মধ্যে তৃণমূল ৮০১টি, সিপিএম ও নির্দল প্রার্থীরা ৫টি করে আসনে জিতেছেন। পঞ্চায়েত সমিতির ৭৭৯টি আসনের মধ্যে ১২৭টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জয়লাভের ঘটনা ঘটেছে। একটি আসনে সিপিএম ও অন্যগুলিতে তৃণমূলের প্রার্থীরা জিতেছেন। তবে জেলা পরিষদের সব আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে।
গত ১৫ জুলাই ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ভোটের দিন অশান্ত হয়ে উঠেছিল বর্ধমান। উঠেছিল বুথ দখল ও ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ। ১৮ জুলাই জেলার মোট ২৩টি বুথে পুনর্নির্বাচন হয়। বুথে নানা রকম অশান্তি পাকানোর অভিযোগে মোট ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এর পরে ভোট গণনার দিন যত এগিয়ে এসেছে, নানা রাজনৈতিক দলের তরফে তাঁদের প্রার্থী ও এজেন্টদের গণনাকেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়ার হুমকির অভিযোগ উঠেছে। জেলাশাসক অবশ্য জানিয়েছেন, যাঁরা পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছেন তাঁরা গণনাকেন্দ্রে ঢুকতে পারবেন। তাঁর বক্তব্য, “যে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী বা এজেন্টরা পরিচয়পত্র নেননি, তাঁরা এমনিতেই কেন্দ্রে ঢুকতে পারবেন না।” উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “বর্ধমান ১ ব্লকে তৃণমূলের ১৪৩ জন, কংগ্রেসের ১২ জন, সিপিএমের ৩৯ জন ও অন্যান্যরা ৩০ জন এমন পরিচয়পত্র নিয়েছেন। সুতরাং, রাজনৈতিক দলের যত এজেন্টকে ঢুকতে না দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তত লোক কিন্তু পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে ব্লক অফিসগুলিতেই যাননি।”
সোমবার প্রথমে গ্রাম পঞ্চায়েত, তার পরে পঞ্চায়েত সমিতি ও সব শেষে জেলা পরিষদের ভোট গণনা হবে বলে জানানো হয়েছে। জেলাশাসক জানান, গণনাকেন্দ্রে বহাল কর্মীদের সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে হাজির হতে বলা হয়েছে। ওই কর্মীরা যাতে সময়ে গণনাকেন্দ্রে পৌঁছতে পারেন, সে জন্য প্রশাসন যানবাহনের ব্যবস্থা করছে। গণনাকেন্দ্রের ভিতরে ব্যাগ, জলের বোতল, মোবাইল ফোন ইত্যাদি কিছুই নিয়ে যেতে দেওয়া হবে না। জেলায় যেহেতু বেশ কয়েকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি, তাই দুপুর ১টার মধ্যে গ্রাম পঞ্চায়েতের সব আসনেরই ফল প্রকাশ হয়ে যাবে বলে জেলাশাসকের আশা। বিকেলে পঞ্চায়েত সমিতি ও রাতের মধ্যে জেলা পরিষদের ফলও প্রকাশ হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে, জানিয়েছেন তিনি।
জেলার মোট ৩১টি কেন্দ্রে ২৫৫টি হলে ২৩৪৯টি টেবিলে ভোটগণনা হবে। সব মিলিয়ে গণনা হবে ১৮৩ রাউন্ড। প্রতিটি কেন্দ্রের সঙ্গে প্রশাসন ও জেলা কন্ট্রোল রুমের যোগাযোগ থাকবে। প্রতিটি কেন্দ্রে ৭০-৯০ জন পুলিশকর্মী এবং এক সেকশন (৯ জন জওয়ান) কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হবে। জওয়ানদের গণনাকেন্দ্র ছাড়াও এলাকার শান্তিরক্ষার কাজেও মোতায়েন করা হবে বলে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে।
আসানসোল মহকুমার ৪টি কেন্দ্রে ২৫টি টেবিলে মোট ২৪ রাউন্ড গণনা হবে। দুর্গাপুরে ৬টি কেন্দ্রে ৪৪টি হলে ৩৭৫টি টেবিলে গণনা হবে মোট ৩০ রাউন্ড। কালনা ও কাটোয়ার পাঁচটি করে কেন্দ্রে যথাক্রমে ৪৫৯টি টেবিলে ৩০ রাউন্ড ও ৩৯০টি টেবিলে ২৮ রাউন্ড ভোটগণনা হবে। বর্ধমান দক্ষিণের ৬টি হলে ৫০টি টেবিলে ৩৪ রাউন্ড, বর্ধমান উত্তরে ৪৭২টি টেবিলে ৩৭ রাউন্ড ভোট গণনা হবে।
গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরের জয়-পরাজয় অনেক সময়ে সামান্য ভোটের ব্যবধানে নির্ধারিত হয় বলে প্রতি বারই ভোটপত্রের বাতিল হওয়াটা সহজে মেনে নিতে পারেন না প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলেরা। জেলাশাসক বলেছেন, “নির্বাচন কমিশন নির্দেশ দিয়েছে, জেলা পরিষদ বা পঞ্চায়েত সমিতির ব্যালট বাক্সে যদি পঞ্চায়েতের ভোট চলে গিয়ে থাকে তাহলে সেগুলিকে প্রাথমিক ভাবে বাতিল করা হবে। যদি দেখা যায়, ওই ভোটের উপরে নির্ভর করছে জয়-পরাজয়, এক মাত্র সে ক্ষেত্রেই সেগুলিকে গোনা হবে।”
|
নজর যেখানে |
পঞ্চায়েত: ২৭৭ পঞ্চায়েত সমিতি: ৩১ জেলা পরিষদ আসন: ৭৫
মোট প্রার্থী: পঞ্চায়েত- ৮৩৮৩, পঞ্চায়েত সমিতি- ১৭৮৬, জেলা পরিষদ- ৩৩৩
গণনাকেন্দ্র: ৩১ সুপারভাইজার: ২৫৬৭ গণনাকারী: ৫২১৩ মোট রাউন্ড: ১৮৩
নিরাপত্তায়: প্রতি কেন্দ্রে পুলিশকর্মী- ৭০-৯০ জন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান- ৯ জন |
|
ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। |
|
ভোটের দিন প্রায় সব জায়গায় ওরা ছাপ্পা মেরেছে। তবু নিরপেক্ষ ভাবে গণনা হলে আমরাই জিতব। সেটা বুঝে এখন আমাদের এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে।
অমল হালদার
জেলা সম্পাদক, সিপিএম |
|
জেলার বেশির ভাগ জায়গাতেই জেতার ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। গণনাও নির্বিঘ্নেই হবে। ফল বেরোনোর পরে কে কোথায়, কোন পদ পাবেন তা নিয়ে আলোচনা হবে।
স্বপন দেবনাথ
জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি, তৃণমূল |
|
এই নির্বাচনে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। অসংখ্য প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারেননি, বুথ দখল করে ছাপ্পা দেওয়া হয়েছে। ভোটের ফল জনমতের প্রতিফলন নয়। আমরা যথাসাধ্য লড়েছি।
আজিজুল হক মণ্ডল
জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি, কংগ্রেস |
|
হারবে ধরে নিয়ে মুখ লুকোনোর রাস্তা খুঁজছে সিপিএম। আর সেই জন্য লাগাতার সন্ত্রাসের মিথ্যা অভিযোগ করে এসেছে ওরা। সেই ধারা বজায় রাখতে গণনার আগেও একই ধুয়ো তুলছে।
অপূর্ব মুখোপাধ্যায়
জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতি, তৃণমূল |
|
কর্মীদের ভয় দেখানো চলছে, যা কাম্য নয়। আশা করি, গণনার দিনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকবে। সন্ত্রাসের আবহে মানুষের প্রকৃত রায়ের প্রতিফলন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সুদেব রায়
জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতি, কংগ্রেস |
|