‘ভাই’
পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করলাম।
করাচি কী সৌদি আরব, বা দুবাইয়ের কোনও ড্রয়িং রুমে বসে আছেন তিনি। আর খুব হাসছেন।
আর হাসতে হাসতে বোম্বাইয়া হিন্দিতে বলছেন, “ইয়ে শালোকো মেরে বারে মে কুছ পাতা নেহি।”
অন্তত এই একটা ব্যাপারে দাউদ ইব্রাহিমকে দশ দেবেন না।
ইদানীং হিন্দি সিনেমাতে, এই যেমন ‘ডি ডে’তে ঋষি কপূর আর ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মুম্বই ২’-এ অক্ষয় কুমারকে তাঁর চরিত্রে অভিনয় করতে দেখে ভারতের ‘দ্য মোস্ট ওয়ান্টেড’ ক্রিমিনাল হাসতেই পারেন।
বহু বছর মুম্বইতে ক্রাইম রিপোর্টিং করছি। ছোটা শাকিল থেকে ছোটা রাজন, সবার সঙ্গে কখনও না কখনও কথা হয়েছে কাজের সূত্রে। এমনকী আমার কাজের খবর পেয়েই ‘পেজ থ্রি’তে অতুল কুলকার্নির চরিত্রটা লিখেছিলেন মধুর ভাণ্ডারকর।
আজ সিনেমার পর্দায় দাউদকে দেখে লোকটা সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি, যা এর আগে কেউ কোনও দিন জানেনি।

‘ভাই’য়ের এখন ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট
প্রথমেই জানিয়ে রাখি, আমাকে অধিকাংশ সময়েই ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র লোকেদের সঙ্গে ডিনার করতে হয়।
যাদের সঙ্গে কথা হয়, তাদের নাম করতে পারব না। কিন্তু এটা বলে দিতেই পারি, ‘ভাই’ (গোটা আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি এই নামেই পরিচিত) কিন্তু আজ ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট ব্যবহার করেন।
কোনও এয়ারপোর্টে তাই ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেল দিয়েই বের হন দাউদ। আইবি-র অফিসাররা এটাও কনফার্ম করেছেন, যখনই কোনও এয়ারপোর্টে তাঁকে কোনও প্রশ্ন করা হয়েছে, তখনই কিছু লোক সঙ্গে সঙ্গে এসে ইমিগ্রেশন অফিসারকে বলেন, “ইনকো ছোড় দো, ইয়ে এমব্যাসি কা আদমি হ্যায়।” পাকিস্তান, সৌদি আরবে ‘ভাই’য়ের এমনই কন্ট্রোল। আর বহু বছর ধরে এমনটাই হয়ে এসেছে।

সাব ঔর বাহার নেহি আতে
আগে আরও বেশি ছিল। কিন্তু ২০১০-এ যখন পৃথিবী জানল ওসামা বিন লাদেন জীবনের শেষ কয়েক মাস পাকিস্তানে কাটিয়েছিল, তখন থেকে পাকিস্তান আর আমেরিকার ইন্টেলিজেন্স দপ্তরের বিরোধ বাঁধে।
পাকিস্তানের কিছু সোর্স আমাকে জানিয়েছিল, দাউদের বাইপাস সার্জারিও হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, কিডনির সমস্যা নিয়েও আজ জর্জরিত দাউদ। নিয়মিত ডায়ালিসিসও করাতে হয় তাঁর।
এই শরীর খারাপের পর থেকে দাউদ আরও ধর্মপ্রাণ হয়ে গিয়েছেন। এই যে রমজান চলছে, নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন ‘ভাই’ মক্কা-মদিনাতেও যাবেন।
এক সময় আইবি অফিসাররা করাচিতে ক্লিফটন (এই এলাকাতেই দাউদের বাড়ি)-এ ‘ভাই’য়ের প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাদের কাছ থেকেই শুনেছি, আগে দাউদ সকালে নিয়মিত হাঁটতে বেরোতেন। তাস খেলতেন সন্ধেবেলা। সেই পাড়া-পড়শিরাই এখন জানাচ্ছেন, “সাব ঔর বাহার নেহি আতে।”

আমি ভয়ের রুটি খাই
দাউদ সম্পর্কে জানতে গিয়ে কিছু লোকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম দাউদের আনঅফিশিয়াল স্পোকস্পার্সন ফাহিম মাচ মাচ (মুম্বইয়া ভাষায় বেশি কথা বলাকে ‘মাচ মাচ’ বলে, সেই থেকে ওর ওই নাম) আর ছোটা শাকিল।
ওদের সঙ্গে কথা বলে অনেক কিছুই জানতে পেরেছিলাম। জেনেছিলাম, আজ আর দাউদ ছোটখাটো পেটি ক্রাইম কী স্মাগলিং করেন না। দাউদের আজ আসল ব্যবসা রিয়েল এস্টেট। ‘ব্লু কলার জব’ থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের পরিবর্তন হয়েছে ‘হোয়াইট কলার জব’য়ে।
ওরা আরও বলছিল, নতুন কেউ দলে যোগ দিলে দাউদ তার একটা ওরিয়েন্টেশন ক্লাস নেন। আর ওই ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে দাউদ স্পিচ শেষ করেন একটা কথা বলে। ‘ভাই’ বলেন, “জিস চিজ কা ম্যায় রোটি খাতা হু, ও হ্যায় দহেশত।” সোজা বাংলায়, “আমার সংসার চলে শুধু একটাই কারণে, সেটা হল ভয়।”

আজও সোনার খনি মুম্বই
আজ কিন্তু মুম্বইতে বিল্ডারদের সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ঝামেলার কোনও খবর শুনতে পাবেন না। তার একটাই কারণ, অদ্ভুত বোঝাপড়ায় চলে গিয়েছে সবাই।
আজ নতুন কোনও বিল্ডিং তৈরি হলেই, বিল্ডারদের কাছে ফোন চলে আসে যে, ‘ভাই’য়ের জন্য ছ’টা ফ্ল্যাট সরিয়ে রাখতে হবে। আর কোনও কমার্শিয়াল বিল্ডিং হলে সাফ বলে দেওয়া হয়, দশটা দোকান দাউদের জন্য সরিয়ে রাখতে হবে। সেগুলো বেনামে কিনে নেয় আন্ডারওয়ার্ল্ড, কিন্তু সবাই জানে দোকানের মালিক কে।
বিল্ডাররা মেনেও নেয় সেটা, কারণ আজও মুম্বইতে দাউদকে সবাই এতটাই ভয় পায়।
ছোটা শাকিলদের সঙ্গে যখন কথা হয়, যখন ওরা ফোন করে ক্লারিফিকেশন দেয়, “আমরা বেটিংয়ে জড়িত নই” বা “এই ব্লাস্টটা আমরা করাইনি”, সেই ফোনগুলোর পর কিন্তু আড্ডা জমে প্রচুর।
এঁরা পর্দায়

বিনোদ খন্না
সিনেমা: রিস্ক

ঋষি কপূর
সিনেমা: ডি ডে

অজয় দেবগণ
সিনেমা: কোম্পানি


ইমরান হাশমি
সিনেমা: ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মুম্বই

অক্ষয়কুমার
সিনেমা: ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মুম্বই ২

রণদীপ হুডা
সিনেমা: ডি

সে দিনই এ রকম একজনের সঙ্গে কাজের কথা শেষ হওয়ার পর উনি বললেন, “আজকাল তো নিশ্চয়ই অফিস যেতে সুবিধে হচ্ছে আপনার?”
এ রকম একটা প্রশ্ন শুনে আমি স্বভাবতই চমকে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “হঠাৎ এটা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
ও পার থেকে উত্তর এসেছিল, “আরে, আন্ধেরিতে ফ্লাইওভার হয়ে গিয়েছে। সুবিধে তো হবেই।”
ওই কথা শুনেই বুঝেছিলাম আজও মুম্বইতে কতটা কন্ট্রোল আছে দুবাই, পাকিস্তানে বসা ডনেদের।
আমার সোর্স অনুযায়ী মুম্বই পুলিশের তিন হাজার ইনফর্মার আছে। কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ডের জন্য কাজ করেন এমন ইনফর্মারের সংখ্যা দশ হাজার।
এই বিরাট ইনফর্মার চেন দিয়েই মুম্বইকে ওরা কন্ট্রোলে রাখে। এবং এ রকম নেটওয়ার্ক বলেই আজও তারা অধরা।

কুড়ি দিন আগেই হোটেলে তারা
যেমন হয়েছিল ২০০৫ সালে যখন দাউদের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় জাভেদ মিঁয়াদাদের ছেলের।
মনে আছে আইবি অফিসারেরা ভেবেছিলেন দুবাইয়ের হায়াত হোটেলে এ বার তাঁদের পক্ষে দাউদকে ধরা সম্ভব হবে। কিন্তু ওঁরা যখন ওখানে পৌঁছন, দাউদ কেন, তার টিমের কাউকেই দেখতে পাননি। তার কারণ দাউদ বিয়ের জন্য বলরুমেই যাননি। দাউদ কুড়ি তলার ঘরে বসে সিসিটিভি-তে পুরো বিয়ের অনুষ্ঠান দেখেছিলেন। শুধু তাই নয়। আইবি অফিসাররা পৌঁছেছিলেন বিয়ের দু’দিন আগে। কিন্তু দাউদ নাকি পৌঁছে গিয়েছিলেন কুড়ি দিন আগেই।
দাউদ মানুষটাই এ রকম। পুলিশের থেকে সব সময় দু’ধাপ এগিয়ে চলেন তিনি। এও শুনেছি পুলিশকে যদি ওঁর দলের কেউ বোকা বানান, তা হলে দাউদ শুধু খুশিই হন না, সেই ব্যক্তিকে দামি গিফট্-ও দেন।
ভাবলে অবাক লাগে, দাউদের বাবা কিন্তু মুম্বই পুলিশের হাবিলদার ছিলেন!
পুলিশকে বোকা বানানো ছাড়া আরও একটা জিনিস পছন্দ করেন দাউদ। স্যুট আর সানগ্লাস।
তাঁর দলের কিছু লোক আমায় জানিয়েছিল দাউদের সব স্যুটের ব্র্যান্ড একটাই। জর্জিও আরমানি। এবং কোনওটারই দাম পাঁচ লক্ষের কম নয়। এ ছাড়াও তাঁর শার্ট ও স্যুট সব সময় হয় কালার কোঅর্ডিনেটেড। এবং সোনার কাফ লিঙ্কও মাস্ট।

D
এত কথা বললাম। কিন্তু ক্রাইম রিপোর্টার তো, রোজ সকালে ভাবি কবে করতে পারব দাউদের একটা ইন্টারভিউ।
জানি না কোনও দিন হবে কি না, তবে আশা করতে দোষ কী?
এ রকম একজন ডন যাঁকে নিয়ে লোকের এত কৌতূহল, তাঁর সঙ্গে কথা বলার রোমাঞ্চটাই আলাদা হবে।
তবে দাউদ সম্বন্ধে এত কিছু বলার পর মুম্বই পুলিশের এক কমিশনারের কথা ভুলতে পারি না।
আমি তাঁকে এক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম দাউদ কোথায় আছে? কী করে? কী খায়? আপনি তো কমিশনার, আপনি জানেন না?
আমার প্রশ্নটা শুনে উনি হেসে বলেছিলেন, “বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে পানের দোকান থেকে সিগারেটটা কিনলেন, সেখানে আপনার পাশে একটা লোক দাঁড়িয়েছিল। সেই হয়তো দাউদ। তার পর যখন বাসে উঠলেন, আপনার সামনের সিটেই হয়তো বসেছিল দাউদ। এয়ারপোর্ট-এ চেক ইন-এর সময় আপনার পিছনের লোকটা হয়তো দাউদ। এবং রাতে যখন ঘুমোতে যান, হয়তো আপনার পাশের ফ্ল্যাটেই তখন শুয়ে আছেন দাউদ।” শুনে বুঝেছিলাম ডন হো তো অ্যায়সা।
দাউদ ইব্রাহিম।
‘ভাই’।
D



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.