আবেদনপত্রে যত্ন করে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা স্কুলছাত্রীর নাম, অভিভাবকের নাম-ঠিকানা, জন্মের তারিখ। সাঁটা আছে রঙিন ছবি। নীচে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার সই, স্থানীয় বিধায়ক কিংবা পুরপিতার সই। ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের টাকার জন্য এমন রাশি রাশি আবেদনপত্র রোজ জমা পড়ছে বিডিও-র দফতরে।
কয়েকশো আবেদনের স্তূপ টেবিলে নিয়ে বসে রয়েছেন বসিরহাটের বিভিন্ন ব্লকের বিডিওরা। ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ বললেই তাঁদের অবস্থার ঠিক বর্ণনা হয়। ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প বিষয়ে তাঁরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে। বসিরহাট ১-এর বিডিও বিপ্লব কুমার মণ্ডল বলেন, “কন্যাশ্রী প্রকল্পের বিষয়ে রাজ্য সরকারের থেকে কোনও নির্দেশ আসেনি। কাদের পরামর্শে, কোথা থেকে আবেদনকারীরা ওই আবেদনপত্র পেলেন, তা-ও জানি না। সরকারি দফতরে কেউ কোনও নথি জমা দিতে এলে তাঁকে রশিদ দেওয়া হয়। কিন্তু এই আবেদনপত্র জমা দেওয়ার প্রেক্ষিতে কোনও রসিদ দেওয়া যাচ্ছে না।” তিনি জানান,
গত কয়েক দিনে এ রকম কয়েকশো আবেদন জমা পড়েছে।
তা শুনে রীতিমতো বিস্মিত নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র। তিনি বলেন, “আমি তো এখনও ওই প্রকল্পের ফাইলে সই-ই করিনি। কী করে ফর্ম বিলি হতে পারে? এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই তদন্ত করব।” মন্ত্রী জানান, প্রকল্পটি অক্টোবর মাস থেকে চালু করার কথা হচ্ছে। তিনি বলেন, “দরিদ্র পরিবারগুলিই এই সুবিধে পাবে। কিন্তু কাকে, কী শর্তে টাকা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে এখনও কিছুই ঠিক হয়নি।”
পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলায় জেলায় প্রচারে মেয়েদের জন্য ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, মেয়েদের পড়াশোনার সুবিধার্থে সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পে এক একজন ছাত্রীকে বছরে এককালীন ৫০০ টাকা এবং ১৭ বছর বয়সে এককালীন ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। গত
বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন... |
|
১৩ জুলাই বসিরহাটে সভায় মুখ্যমন্ত্রী এই প্রকল্প ঘোষণা করেন। তার পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা আবেদনপত্র বিলি করার ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে ওঠেন বলে
জানা যাচ্ছে।
কারা বিলি করছে আবেদনপত্র, সে বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের কাছে কোনও খবরই নেই। কিন্তু গ্রামের মানুষ বলছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিস থেকে বিলি করা হচ্ছে আবেদনপত্র। এমনকী ফটোকপি করার দোকানেও তা বিক্রি হচ্ছে। ছাত্রীরা জানালেন, এক টাকা থেকে শুরু করে ১০ টাকা পর্যন্ত দাম নেওয়া হয়েছে। পঞ্চানন দালাল স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী পিয়ালি দেবনাথ, চৈতালি দাস, রুমা দাস বলেন, “টাকা দিয়ে আবেদনপত্র কিনে তা পূরণ করে পরিবারের আয়ের শংসাপত্র-সহ বিধায়ক, প্রধান শিক্ষিকার সই করিয়ে বিডিও অফিসে জমা দিয়েছি। সেখানে বলা হয়েছে, সরকারি নির্দেশ বলে আবেদনপত্র জমা নিলেও রসিদ দেওয়া যাবে না। এখন কী হবে জানি না।”
কিন্তু বিধায়ক, সাংসদরা প্রকল্পের বিষয়ে কিছু না জেনেই কী করে সই করছেন আবেদনপত্রে? বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রের সিপিএম বিধায়ক নারায়ণ মুখোপাধ্যায় বলেন, “বিধানসভায় তৃণমূল নেতারা কন্যাশ্রী প্রকল্পের কথা বলেছিলেন। তাই আমাদের কাছে যে সব আবেদনকারী এসেছিলেন তাঁদের পারিবারিক আয়ের শংসাপত্র দেখে তাতে সই করেছি। রাজনীতি করি। সই না করলে মানুষ ভুল বুঝতে পারে, তাই সই করেছি।” বসিরহাটের তৃণমূল সাংসদ নুরুল ইসলাম বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী কন্যাশ্রী প্রকল্পের কথা বলেছেন। আমি জনপ্রতিনিধি, তাই আমার কাছে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের আবেদনপত্রে সই করে দিয়েছি। এই প্রকল্প যাতে দ্রুত চালু করা হয় সে জন্য আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।”
আর কী বলছেন বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকারা?
টাকি ষষ্ঠীধর লালমোহন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মণীষা মুখোপাধ্যায় বলেন, “প্রকল্পের উদ্দেশ্য ভাল। সরকারি কোনও নির্দেশ ছাড়াই যে ভাবে ছাত্রী এবং তাঁদের অভিভাবকেরা সইয়ের জন্য স্কুলে ভিড় করছেন তাতে সমস্যা হচ্ছে।” টাকির পুরপ্রধান সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের কাছেও অনেক আবেদনপত্র আসছে। আমরা তা জমা রেখে দিচ্ছি। এ ব্যাপারে সরকারি নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি।” |