|
|
|
|
পথ দেখাল কারাগার |
|
সীমান্ত-বন্দি রক্ষীদের
অবসাদেও দাওয়াই সংস্কৃতি
অত্রি মিত্র • কলকাতা |
|
ভিটেবাড়ি, আত্মীয়-পরিজন থেকে বহু দূরে। নির্বান্ধব সীমান্তেই ওঁদের বারমাস্যা।
কাঁটাতারের এ-পারে, কাঁধে রাইফেল আর চোখে বাইনোকুলার নিয়ে অতন্দ্র প্রহরায় কাটে এক দিন, প্রতি দিন। গরু-ছাগল হোক বা ছাপোষা মানুষ, চোরাচালানকারী বা জঙ্গি, কেউ যেন গণ্ডি না-পেরোয়। ওঁদের জীবনে ছুটি দুষ্প্রাপ্য, বিনোদন আকাশের চাঁদ। মাথা খুঁড়লেও বাড়ি যাওয়ার অনুমতি মেলে না।
আর এর থেকে হতাশা। তার জেরে কেউ আত্মঘাতী হন, কেউ দুর্ব্যবহার করেন সহকর্মী, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। কোথাও নিজেদের মধ্যে গুলি চালাচালি হয়! মানসিক সুস্থিতি হারানো জওয়ান উন্মত্তের মতো গুলি চালিয়ে অফিসার বা সহকর্মীদের মেরে ফেলেছেন, এমন নজিরও একাধিক। জওয়ানদের মনে শিকড় গাড়া এই অবসাদ উৎপাটনে এ বার সাংস্কৃতিক বিনোদন চালু করতে চলেছেন বিএসএফ কর্তৃপক্ষ। সৃষ্টিশীল কাজে নিয়োজিত রেখে জেলবন্দিদের সংশোধনের লক্ষ্যে ‘কালচার-থেরাপি’ পশ্চিমবঙ্গে আগেই শুরু হয়েছে। সীমান্ত-বন্দি জওয়ানদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হবে সেই একই দাওয়াই।
এবং এর নেপথ্যেও কিন্তু সেই একই কারিগর!
বেশ কিছু দিন পশ্চিমবঙ্গ কারা দফতরের দায়িত্বে ছিলেন আইপিএস অফিসার বংশীধর শর্মা। তাঁর আমলেই কালচার-থেরাপির মাধ্যমে কয়েদি সংশোধনের প্রক্রিয়ার সূচনা। রাজ্যের বিভিন্ন সংশোধনাগারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের অভিনীত নৃত্যনাট্য ও নাটক ইতিমধ্যে সাড়া ফেলেছে। খুনের আসামিদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে। আর এই সাফল্যে উজ্জীবিত বংশীধরবাবু এর সুফল দিতে চাইছেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীকেও। বর্তমানে বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় এডিজি বংশীধরবাবু বলছেন, “সারা দেশ যখন ঘুমোয়, আমাদের জওয়ানেরা সীমান্ত রক্ষা করেন। অথচ ওঁদের জীবনে বৈচিত্র্য নেই! খেলাধুলোর বিভিন্ন সুযোগ থাকলেও সিংহভাগ তা থেকে দূরে। আমরা ওঁদের কালচার থেরাপিতে সামিল করতে চাইছি।” বংশীধরবাবুর দাবি, বাইরে থেকে যা দেখা যায়, সীমান্তরক্ষীদের জীবন তার চেয়েও কঠিন। কী রকম?
এডিজি বলেন, “জওয়ানদের বাৎসরিক ছুটির তালিকা আগাম তৈরি থাকে। সীমান্তে প্রহরীর সংখ্যা পর্যাপ্ত রাখতে হয় বলে হুট করে কাউকে ছুটি দেওয়া যায় না। এ দিকে বাড়িতে অঘটন কিছু ঘটলে মোবাইল ফোনের সুবাদে দেশের অন্য প্রান্তে মোতায়েন জওয়ানও সঙ্গে সঙ্গে জেনে যাচ্ছেন। অথচ পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। এতে মানসিক চাপ বাড়ছে। গ্রাস করছে হতাশা, অবসাদ।” |
আত্মঘাতী বিএসএফ |
সাল |
ক’জন |
২০০৭ |
১৮ |
২০০৮ |
১৫ |
২০০৯ |
১৩ |
২০১০ |
১৪ |
২০১১ |
২১ |
২০১২ |
১৭ |
২০১৩ |
৬ (জুন পর্যন্ত) |
* পূর্বাঞ্চলের হিসেব |
|
বিএসএফ-সূত্রের খবর: চলতি বছরে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ও মায়ানমার সীমান্তে ছ’জন জওয়ান আত্মহত্যা করেছেন। গত দু’বছরে আত্মহত্যার সংখ্যা যথাক্রমে ২১ ও ১৭।
কিন্তু সাংস্কৃতিক বিনোদনের সুযোগ দেওয়া গেলে জওয়ানদের মধ্যে অবসাদের প্রকোপ অনেকটা কাটানো যাবে বলে আশাবাদী বিএসএফ-কর্তা। রাজ্য কারা দফতরে সংশোধন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরাও প্রয়াসটিকে স্বাগত জানাচ্ছেন। বন্দিদের অঙ্কন শিক্ষক চিত্ত দে’র কথায়, “খুব ইতিবাচক ভাবনা। যে কেউ এক ধরনের কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। জওয়ানদের হতাশাটা অনেক বেশি। ওঁদের বিনোদন অত্যন্ত প্রয়োজন।” বন্দিদের সংশোধন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ দিন জড়িত যে নৃত্যশিল্পী, সেই অলকানন্দা রায়কে জওয়ানদের ক্ষেত্রেও একই ভূমিকায় দেখতে চান চান বিএসএফ-কর্তৃপক্ষ। অলকানন্দাদেবী মনে করেন, “সেনা বা বিএসএফের জীবন কাঠখোট্টা বলে যে ধারণা, তা মোটেই ঠিক নয়। ওঁদের জীবনে আসলে বিনোদন নেই। তার উপরে দিনের পর দিন পরিবার ছেড়ে থাকা...।” ওঁদের নিয়ে তিনি কী ভাবছেন?
জওয়ানদের দৈনন্দিন প্যারেডে ‘ছন্দ’ খুঁজে পেয়েছেন নৃত্যশিল্পী। তিনি এখন চান তাঁদের শারীরিক কসরতের মধ্যেও ছন্দ আনতে। এমনকী, ওঁদের দিয়ে ‘গাহি সাম্যের গান’ গীতি-আলেখ্য করার ভাবনাও রয়েছে তাঁর মাথায়। “ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে একটা সুবিধে, দু’দেশের সংস্কৃতির ভাষা অভিন্ন। আমার ইচ্ছে, দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের নিয়ে যৌথ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা। তাতে দু’দেশের সম্পর্কেরও উন্নতি হবে।” জানাচ্ছেন অলকানন্দা।
কিন্তু বিএসএফের সব জওয়ান তো বাংলা বুঝবেন না!
অলকানন্দাদেবীর জবাব, “ওঁরা নাচবেন। নাচের ভাষা আলাদা হয় না।” এডিজি বংশীধরবাবুও বলেন, “এখন বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ মূলত পুলিশের কাজ করে। তাতে স্থানীয় ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় থাকা জরুরি। আমরা সেই কাজটাই করার চেষ্টা করব। এতে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে জওয়ানদের সম্পর্ক সহজ হবে।” |
|
|
|
|
|