তখন ছিল হোল্ডল কাঁধে ট্রেনে চেপে পশ্চিমে হাওয়াবদলের দিন। তারপর প্লেনে চেপে দেশ-বিদেশ ভ্রমণের পালা। আর এ যুগে দু’চাকায় চেপে লাদাখ। পর্যটন এখন অভিযানের নেশা।
সেই নেশাই এখন বদলে যাওয়া পর্যটন ব্যবসার নয়া সূত্র। শিল্পের পরিভাষায় যা ‘অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম’ বা রোমাঞ্চকর পর্যটন। সেই চাহিদাই বেঙ্গালুরুতে নামী সংস্থার চাকরি ছেড়ে এই ব্যবসায় টাকা ঢালতে সাহস জুগিয়েছে পেশাদার তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী দীপমাল্য নাথকেও। পেশার টানে কলকাতা ছাড়লেও এই ব্যবসাই তাঁকে ফিরিয়ে এনেছে শহরে। শুধু দু’চাকার অভিযানই নয়, সেই অভিযানের জন্য জরুরি সাজ-সরঞ্জামের চাহিদা আবার তৈরি করছে নয়া ব্যবসার সূত্র। পর্যটনের পাশাপাশি সেই ব্যবসাতেও লগ্নি করেছেন দীপমাল্যবাবু।
পর্যটন শিল্পের মতে, এ দেশে প্রথাগত পর্যটন শিল্প তার পরিচিত গণ্ডি ছাড়িয়ে ক্রমশ ছড়াচ্ছে। শুধু দ্রষ্টব্য স্থান বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই আর একমাত্র আকর্ষণ নয়। বরং সেখানে পৌঁছনোর সফরটাই একটা আলাদা স্বাদ আনছে পর্যটকদের কাছে। জিপ বা মোটরবাইকে চেপে ঘোরার পাশাপাশি ক্যাম্পে থাকা, নদীতে র্যাফটিং করার আগ্রহ বাড়ছে। এ ব্যাপারে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম ডেভে- লপমেন্ট ইনডেক্স রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম বা রোমাঞ্চকর পর্যটন বৃদ্ধির হার ২০১১-’১২ সালেই দাঁড়ায় প্রায় ১৭%। প্রতি চারটি পর্যটনের মধ্যে একটি এ ধরনের। ২০৫০-এর মধ্যে পর্যটন ব্যবসার ৫০ শতাংশই আসবে এই ধরনের রোমাঞ্চকর পর্যটন থেকে। আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যাডভেঞ্চার ট্র্যাভেল ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের হিসেবে, ২০১১-য় বিশ্বে এই ব্যবসায় যুক্ত সংস্থাগুলির ৬৩ শতাংশের আয় বেড়েছিল। গড় আয় বৃদ্ধি ১৭.৩%। |
অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া-র প্রেসিডেন্ট অক্ষয় কুমারের দাবি, বিদেশিদের সঙ্গে ভারতীয় পর্যটকদের হাত ধরে ভারতে রোমাঞ্চকর পর্যটন ব্যবসা বার্ষিক গড়ে ২০-২৫% হারে বাড়ছে। যা ইতিমধ্যেই সার্বিক পর্যটন শিল্পের ২-৪% দখল করেছে। বাইকে চেপে ভ্রমণ সেই তালিকায় ছোট হলেও তার বাজার বাড়ছে দ্রুতগতিতে।
সেই বাজার অবশ্য অনেক আগে থেকেই ছিল জার্মানি, ব্রিটেন, গ্রিস, কানাডা, মরক্কো, নিউজিল্যান্ড, তিব্বত-সহ বিভিন্ন দেশে। এই বাজার ধরার জন্য বিশেষ ধরনের মোটরবাইকও তৈরি করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি। ভারতে হিমালয়ের পাকদণ্ডী এত দিন মূলত বিদেশিদের গন্তব্য হলেও এ বার সেই রাস্তায় চাকা গড়াচ্ছেন ভারতীয়, এমনকী বাঙালিরাও। ‘লিট্ল টিবেট রোড’ ধরে মানালি থেকে লে বা স্পিতি উপত্যকা এই ধরনের পর্যটকদের কাছে সেরা আকর্ষণ হলেও পশ্চিমবঙ্গ-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলও ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে সেই মানচিত্রে। দীপমাল্যবাবু জানাচ্ছেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও ভুটানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পর্যটকদের বাইকের চাকা গড়িয়েছে পুরুলিয়া এবং সুন্দরবনেও।
সেই সম্ভাবনার বাজার ধরাই লক্ষ্য দীপমাল্যবাবুর। কলকাতায় কলেজের পাঠ শেষে বেঙ্গালুরুতে ওই তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদারের নেশা ছিল মোটরবাইক। বেঙ্গালুরুর একটি বাইক ক্লাবের কর্তাও ছিলেন। মোটরবাইকে চেপে ভ্রমণের জন্য ‘একস্ট্রিম মোটরিং অ্যাডভেঞ্চার’ সংস্থা তৈরি করে পর্যটন ব্যবসায় প্রবেশ। তাঁর কথায়, “গাড়ি যেন খাঁচা। আর বাইকে চেপে রাস্তায় চলা ‘ফ্রি-সোল’। গোটা সফরের অনুভূতিই আলাদা।”
দীপমাল্যবাবু জানাচ্ছেন, এ রাজ্যে তৈরি হয়েছে একাধিক বাইক-ক্লাব। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও বাইকে সওয়ার হয়ে এই অভিযানের স্বাদ নিতে চাইছেন। বাইক পর্যটন ব্যবসায় দেড় বছরেই না-লাভ-না-ক্ষতির সীমায় পৌঁছেছেন তাঁরা। এ বার বাইক সফরের সাজ-সরঞ্জামের ব্যবসার জন্য কলকাতায় তাঁরা খুলেছেন প্রথম বিপণি ‘গিয়ার-আপ’। অদূর ভবিষ্যতে এই শহরেই সরঞ্জাম তৈরির পরিকল্পনাও আছে তাঁদের। |