বলিউডের বাদশা চলে যাওয়ার বহু ক্ষণ পরেও চুড়ো করে বাঁধা খোঁপাটা খুলতে হাত সরছে না মিনতি মোদক ওরফে মিনির।
কী করেই বা খোলেন! প্রকাশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওই চুলেই তো হাত ছুঁইয়েছেন স্বয়ং শাহরুখ খান। বলেছেন, “আই লাভ ইওর হেয়ার!” তা হলে মিনির দোষ কী? শাহরুখের সামনে চেন্নাই এক্সপ্রেস-এর ‘বনকে তিতলি দিল উড়া’-র সঙ্গে নেচেছিলেন সেলিমপুরের তরুণী! শোয়ের পরে তাঁর মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের নায়কের ছোঁয়ায় মিনির হৃদয়ও উড়ছে রঙিন প্রজাপতি হয়ে।
সাংবাদিকতার ছাত্রী রচনা শ্রীবাস্তবই বা কী করে ভুলবেন নিউ টাউনের সিটি সেন্টারের এই শনি-সন্ধে। চেন্নাই এক্সপ্রেস-এর নায়িকা দীপিকা পাড়ুকোন আসেননি। এক লহমার জন্য রচনাই তো হয়েছিলেন কিং খানের ‘মিনাম্মা’! ছবির মুক্তির আগেই হিট হওয়া সংলাপ মঞ্চে আউড়েছিলেন শাহরুখ: ‘মেরি ডিকশনারি মে ইম্পসিব্ল নাম কা শব্দ হি নেহি হ্যায়!’ রচনা সঙ্গে-সঙ্গে দীপিকার চোখা সংলাপেই জবাব দিয়েছেন, ‘কাঁহা সে খরিদা অ্যায়সি বকওয়াস্ ডিকশনারি!’ কম যান না রচনার সহপাঠী নয়নদীপ রক্ষিতও। ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর / কাম অন দ্য ডান্স ফ্লোর’-গানের সঙ্গের তামিল সংলাপ ঠোঁটস্থ করে তা এই সন্ধেয় শাহরুখকে শেখানোর মাস্টারমশাই হয়েছিলেন নয়নই। কলকাতার ঝকঝকে দুই তরুণ-তরুণীর গালে চুমু দিয়ে শাহরুখ তাঁর ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন। |
রচনা-নয়ন-মিনিরা না-হয় ভাগ্যবান! আয়োজকদের ডাকেই শাহরুখের সঙ্গে তাঁরা এক মঞ্চে উঠেছিলেন। কিন্তু মঞ্চের ধারে-কাছে যাঁরা আসতে পারেননি, তাঁদের অনেকের কাছেও এই সন্ধেটা পরম প্রাপ্তি হয়ে রইল। চেন্নাই এক্সপ্রেস-স্পেশাল কালো বর্ডারের সাদা হ্যাট শাহরুখ নিজের মাথা থেকে ছুড়ে দিয়েছেন জনতার মধ্যে। কার হাতে পড়ল সেই জাদু-টুপি, ব্যাকস্টেজে দাঁড়িয়ে তা অবশ্য ঠাহর করা গেল না। শুধু কি তা-ই? ‘আজ আমার জন্মদিন, তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই’— পোস্টার লিখে যে অনামা যুবক ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁকে উদ্দেশ করেও তো ডন ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ শুনিয়ে গেলেন!
উত্তর ভারতীয় নায়ক আর দক্ষিণী নায়িকার মজাদার রোম্যান্সের কাহিনি মুক্তি পাবে ৯ অগস্ট। তার দু’হপ্তা আগে ছবির প্রচারে এসে শাহরুখ যে ঝোড়ো সন্ধে উপহার দিলেন, তা ফিল্মি চিত্রনাট্যের থেকে কোনও অংশে কম যায় না! হতে পারে, এটা বিপণনের স্ট্র্যাটেজি! তবু কলকাতায় তাঁর ভক্তদের সামনে মুম্বইয়ের মেগাস্টার যেন প্রায় কল্পতরু হয়ে উঠেছিলেন। বাঁধাধরা একটি সাংবাদিক সম্মেলন ছিল ঠিকই। সেখানে সলমন খানের সঙ্গে অধুনা ডনের সম্পর্ক কিংবা ‘সারোগেট সন্তান’ নিয়ে শাহরুখের অভিমত— নানা প্রসঙ্গই উঠে এসেছে। কিন্তু নায়কের আসলি মেজাজের ছোঁয়াচ মিলেছে খোলা মঞ্চে ‘কমন ম্যান’দের সামনে।
সেই ‘কমন ম্যান’ সিটি সেন্টারের মঞ্চে শাহরুখকে একটি বার দেখার জন্য যাঁরা অনেকেই প্রায় সাত-সকাল থেকে ভিড় করেছিলেন। শাহরুখ তাঁদের সামনে হাজির হলেন সন্ধে সওয়া সাতটা নাগাদ! এবং অনেকেই একমত যে, এটা মোটেও নামমাত্র আবির্ভাব হয়ে রইল না! টানা ৪০ মিনিট নেচে-গেয়ে-ডায়লগে আক্ষরিক অর্থেই মাত করে গেলেন তাঁদের নায়ক। শোয়ে চেন্নাই এক্সপ্রেস-এর সংলাপ-গানের চর্চা তো চলবেই! কিন্তু একই সঙ্গে ভক্তদের জন্য কবেকার ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ বা ‘ডন’-এর গান-সংলাপের নস্ট্যালজিয়াও অকাতরে ফিরিয়ে দিলেন বাদশা। শাহরুখের কণ্ঠে কেকেআর-এর গান ‘করব, লড়ব জিতব রে’-ও বাদ পড়ল না।
চেন্নাই এক্সপ্রেসের আরও একটি বহুচর্চিত সংলাপ এ দিন বারবার শুনিয়েছেন শাহরুখ ‘ডোন্ট মিসআন্ডারস্ট্যান্ড দ্য পাওয়ার অফ কমন ম্যান’। বলেছেন, “আমরা যে যা-ই করি না কেন, আসলে কিন্তু আমরা সকলেই এক-একজন সাধারণ মানুষ! আমাদের সবার মধ্যেই শক্তি আছে! আমাদের, মানে এই কমন ম্যানকে যেন কেউ ছোট না করেন।” নিজের লেখা এই সান্ধ্য-চিত্রনাট্য যেন সারা ক্ষণ ‘কমন ম্যান’দেরই উৎসর্গ করলেন বলিউডের বাদশা! |
‘‘আচ্ছা, পাবলিকের মধ্যে থেকে কাউকে মঞ্চে তুলে নাচ হতে পারে না!’’—প্রশ্নটা করেই যেন দুঃখিত হয়ে পড়লেন কিং খান! “বুঝেছি, কী করেই বা সেটা হবে! নিরাপত্তার ব্যাপার। এখন ওপরে উঠতে গিয়ে কারও চোট-ফোট লাগতে পারে!” আয়োজকদের অপারগতার দিকটাও ব্যাখ্যা করলেন নিজেই। এবং নিজেকে জনতার মাঝে ছুড়ে দিতে পারলেন না বলেও বারবার আফশোস করলেন। তাই মঞ্চ থেকেই মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করলেন জনতাকে। ক্রমাগত লাফঝাঁপ-নাচাগানার ক্লান্তি, দরদরিয়ে ঘামকে একফোঁটাও পাত্তা দিলেন না এই চল্লিশ মিনিটে।
এমন জমাটি শো শেষ হয়েও শেষ হচ্ছিল না কিছুতে। মঞ্চ থেকে প্রস্থানের পরেও সবাইকে চমকে হঠাৎ ফিরে এলেন শাহরুখ! সিটি সেন্টারের র্যাম্পের ডাইনে-বাঁয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেপরোয়া ভঙ্গিতে পাঁচিলে উঠে দাঁড়ালেন। শো চলাকালীন কিন্তু বারবার বড়দা-সুলভ ভঙ্গিতে জনতাকে সাবধানে দাঁড়ানোর কথাই বলছিলেন। কিন্তু পাঁচিলে দণ্ডায়মান ৪৭ বছরের তরুণ তাঁর পাগল-ভক্তদেরও ছাপিয়ে গেলেন। অঘটন এড়াতে নিরাপত্তারক্ষীরা কোনওমতে ডনের পদযুগল চেপে থাকলেন।
দুপুর দেড়টা থেকে তাক করে মঞ্চের কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন গড়িয়ার তরুণী চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট সবিতা মাইতি। তিনি বলছিলেন, “এর আগে রা-ওয়ান-এর প্রচারের সময়েও শাহরুখের শো দেখতে গিয়েছিলাম! কিন্তু আজকের এই ছটফটে
প্রাণের ছোঁয়াটা সে-দিন ছিল
না!” সত্যিই, এই সন্ধের শাহরুখের সঙ্গে বরং তুলনা চলতে পারে কেকেআর-এর আইপিএল জয়ের পরে ইডেনের শাহরুখের। যাঁর সঙ্গে কলকাতার সম্পর্কটা এখন অ-নেক বেশি নিবিড়।
শোয়ের কিছু ক্ষণ বাদে সাংবাদিক সম্মেলনে কিং খান নিজেও বললেন, “বাংলার অ্যাম্বাসাডর হতে পেরে আমি সত্যিই গর্বিত। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডারের কাজ হল, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বাংলার প্রচার করা। আমি সেই কাজটা করে চলেছি।” ঠিক যেমন মঞ্চে দাঁড়িয়ে কেকেআর-কর্ণধার বলেছেন, “আমার শহর কলকাতায় আসার জন্য আমি সব সময়ই একটা ছুতো খুঁজি। এ বার চেন্নাই এক্সপ্রেস-এর ছুতো পেয়ে গিয়েছি।” চটজলদি রপ্ত করা বাংলায় শুনিয়েছেন, “এখানে এসে দারুণ লাগছে। কলকাতা অনেক ধন্যবাদ! তোমারে খু-উ-ব ভালবাসি!’’ সুষ্ঠু ভাবে এমন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য বিধাননগরের পুলিশকেও ঢালাও শংসাপত্র দিয়ে গিয়েছেন তিনি। |
ভবানীপুরের শাহরুখ ডিসাইপ্ল্স-এর ভক্তকুল থেকে শুরু করে কলেজ ফাঁকি দিয়ে হাজির বি-টেক ছাত্রী প্রিয়ঙ্কা, সম্রাজ্ঞী বা অদিতিরা খিদে-তেষ্টার তোয়াক্কা না-করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছেন। লাগোয়া আবাসনের বারান্দাগুলোতেও তিলধারণের জায়গা নেই। নিজের ফ্ল্যাটে বসে এমন বলিউডি শোয়ের আস্বাদ কে-ই বা মিস্ করবেন! ওই তল্লাটে পরিচারিকার কাজ করতে আসা নোয়াপাড়া-আটঘরার মিনতি-শান্তি-তানিয়ারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ধরে গেলেও ‘সারুক’কে না-দেখে জমি ছাড়েননি। শাহরুখের টানে ভিআইপি-র মোড় থেকে সিটি সেন্টার অবধি অটো ভাড়া তিন গুণ বেড়ে ২০ টাকা হয়ে গিয়েছে।
এই কলকাতাকে চেন্নাই এক্সপ্রেস-এর গানের লিরিক ধার করেই তাঁর সেলাম জানালেন শাহরুখ। কলকাতা ‘তেরা রাস্তা ম্যায় ছোড়ু না!’
|