হুগলি নদীতে ক্রমাগত পলি জমতে থাকায় কলকাতা বন্দর বিপাকে পড়ছে। আবার বন্দর বাঁচাতে সেই পলি তোলায় এবং তা ফের মোহনার কাছেই ফেলতে থাকায় নদী-সমুদ্রের জীববৈচিত্রও বিপন্ন হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ। মাছ-সহ জলের প্রাণীরা সঙ্কটে। এই ব্যাপারে কলকাতা হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়ে জনস্বার্থে মামলাও করা হয়েছে।
জাহাজ চলাচল অবাধ করার জন্য গঙ্গার নাব্যতা বাড়াতে ড্রেজিং করছে জাহাজ মন্ত্রক। কিন্তু সেই পলি তুলে মোহনার কাছে ফেলার ফলেই দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা। এই অবস্থায় কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ শুক্রবার জাহাজ মন্ত্রক, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এবং কলকাতা বন্দরকে চার সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে।
গঙ্গায় পলি পড়ে নাব্যতা কমার ফলে কলকাতা বন্দরের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়ে পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞেরা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন। গত ৬ জুন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত হাইকোর্টে এ বিষয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। তাতে ড্রেজিং সংক্রান্ত নানান সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে জীববৈচিত্রের বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি। সুভাষবাবুর অভিযোগ, ড্রেজিং করতে হলে পরিবেশের উপরে তার কী প্রভাব পড়বে, সেটা আগে সমীক্ষা করতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমন কোনও সমীক্ষাই করা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মোহনায় পলি ফেলায় নদীর স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে জলের অভ্যন্তরের পরিবেশ। ফলে ওই এলাকার জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ড্রেজিংয়ের আগে সমীক্ষা না-করায় পলি তুলতে গিয়েও সংশ্লিষ্ট এলাকার মাছ বা অন্য প্রাণীদের মেরে ফেলা হচ্ছে। সেই ক্ষতি পূরণ করারও ব্যবস্থা হচ্ছে না। সুভাষবাবু বলেন, “শুধু মোহনার কাছে পলি ফেলাই নয়, পরিকল্পনাহীন ড্রেজিংয়ের জন্য নদীর ভিতরের দিকেও জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।” মোহনার কাছে ফেলা পলি ঢেউয়ের ধাক্কায় ফের ফিরে যাচ্ছে নদীতেই। কলকাতা বন্দরের সঙ্গিন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁর বক্তব্য, গঙ্গায় পলি পড়ে নাব্যতা কমে গিয়েছে। খাল কাটা, তীরবর্তী শহর ও গ্রামে জল সরবরাহের জন্য কমছে জলের পরিমাণও। ফরাক্কা চুক্তি অনুযায়ী শুখা মরসুমে কলকাতা বন্দরের ৪০ হাজার কিউসেক জল পাওয়ার কথা। কিন্তু গত ১৫ বছরে তার অর্ধেক পরিমাণ (২০ হাজার কিউসেক) জল পেয়েছে এই বন্দর। এই সব কারণেই কলকাতা বন্দরের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে বলে তাঁর দাবি। তিনি বলেন, “কলকাতা বন্দর বিপন্ন হলে চিন, মায়ানমারের সঙ্গে প্রস্তাবিত বাণিজ্যের কাজকর্মও অচল হয়ে পড়বে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, কলকাতা বন্দরের উপরে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য তো বটেই, নেপাল, ভুটানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলিও নির্ভরশীল। এই বন্দর বিপন্ন হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্য এবং দেশগুলিতেও তার প্রভাব পড়বে। অনেকেই মনে করেন, কলকাতা বন্দরকে বাঁচাতে হলে সমুদ্রের আরও কাছাকাছি বন্দর তৈরি করতে হবে। সুভাষবাবু বলেন, “কলকাতা বন্দরকে স্বাভাবিক রাখতে হলে নতুন বন্দর নির্মাণ করতে হবে শালুকখালি (হলদিয়া), ডায়মন্ড হারবার, সাগরদ্বীপ এবং মোহনার কাছে।” ওই বন্দর তৈরি না-হওয়া পর্যন্ত ড্রেজিং করেই কলকাতা বন্দরের কাজ চালাতে হবে মনে করেন তিনি।
সুভাষবাবু আরও বলেন, “সাগরদ্বীপে বন্দরের পরিকাঠামোর জন্য জমি প্রয়োজন। তাই এই মামলায় রাজ্য সরকারকেও যুক্ত করা হয়েছে।” কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের সঙ্গে সঙ্গে এ দিন রাজ্যের কাছ থেকেও চার সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা চেয়েছে আদালত। সুভাষবাবু জানান, ছ’সপ্তাহ পরে ফের এর শুনানি হবে বলে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। |