|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
আবার তিনি স্বভূমিতে ফিরছেন |
অনাথনাথ দাস |
দ্য ডায়েরিজ অব রথীন্দ্রনাথ টেগোর, সম্পাদনা: সুপ্রিয়া রায়। কারিগর, ৪৫০.০০ |
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিনপঞ্জি ও অন্যান্য কিছু উপাদান যথাসম্ভব সংগ্রহ করে সুপ্রিয়া রায় একত্র করলেন। কাজটি দুরূহ, সেই সঙ্গে আকর্ষণীয়— বিশেষত রবীন্দ্রনাথের কর্মজগতের যাঁরা অনুসন্ধায়ী, তাঁদের কাছে অবশ্যই।
ইতিপূর্বে স্বল্প কয়েকজন ব্যক্তি রথীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছেন— তাঁর সম্পর্কে একটি বাক্যবন্ধ সীমিত ভাবে এক সময় প্রচলিত হয়: ‘সেই নেপথ্যচারী মানুষটি’। সে-কথা আজ ক’জনই বা মনে রেখেছেন! হয়তো রথীন্দ্রনাথ যা চেয়েছিলেন সেটিই ঘটেছে। পিতা তাঁর পুত্রের জন্মদিন উপলক্ষে দীর্ঘ একটি কবিতা রচনা করেন, সংকোচের সঙ্গে সে কালের এক বিখ্যাত পত্রিকায় পাঠাবার ব্যবস্থাও করেন। বন্ধুস্থানীয় সেই সম্পাদক নাকি কবিতার বিষয়টি জানতে পেরে পরামর্শ দিয়েছিলেন না-পাঠাতে। অনেক পরে শান্তিনিকেতন যখন ‘বিশ্বভারতী’-র অভিধা-চিহ্নিত, ওই সময় এক শ্রেণির মানুষ আড়ালে বলতেন ‘বিশ্ব’ বা ‘রথী’। হয়তো রবীন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথ এই রটনা শুনেছিলেন, কিন্তু কী-ই বা করার ছিল তখন!
রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা, পাঠক লক্ষ করে থাকবেন ‘গীতালি’ কাব্যের প্রারম্ভিক কবিতা, যেটি রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর উদ্দেশে লিখিত হয়— সেখানে একবারও ব্যক্তিনামের উল্লেখ নেই। এই ভাবেই সন্তর্পণে পুত্রকে আড়াল করে রাখছিলেন। তবে সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে এই প্রচ্ছন্নতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সব মিলিয়ে পুত্রের ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হওয়ার উপযুক্ত অবকাশ পাচ্ছিল না। এক সময় রথীন্দ্রনাথ ক্রমশ গভীর অবসাদের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলেন। তাঁর ইংরেজি ও বাংলায় লেখা আত্মস্মৃতি (On the Edges of Time, পিতৃস্মৃতি), যে বহুপঠিত এ কথা এখন বলা যাবে না, তবে তিনি সাহিত্য চর্চা করলে যে অনেক দূর এগোতে পারতেন, তার চিহ্ন এই দুটি বইয়ে থেকে গিয়েছে। অন্যান্য অনেক টুকরো লেখাও দেখা যায়, সেটি তার বিচিত্রগামী একটা চেহারার ইঙ্গিত দেয়। এই গুণ তাঁর অন্য অনেক দিকেও লক্ষ করা যায়। পিতার অস্থিরতা-গুণ তাঁর মধ্যেও প্রকাশিত হতে দেখি। বহু গুণ নিয়েও রথীন্দ্রনাথ কেন অবসন্ন হয়ে গেলেন, তার বিচার আর হল না। আলোচ্য বইটি তাঁর লেখা অনেক দিনলিপি আশ্রয় করে গঠিত। এই দিনলিপিগুলির মধ্যে তাঁর বিচিত্রগামিতার বহু প্রমাণ থাকলেও মাঝে মাঝে চকিত অবসন্নতা ছায়া ফেলেছে। রথীন্দ্রনাথের এই ধরনের আরও কিছু রচনা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, সেগুলি অপ্রকাশিতই থেকে গেল— হয়তো ভবিষ্যতে কেউ প্রকাশ করবেন। ‘সেই নেপথ্যচারী মানুষ’টি হীরেন্দ্রনাথ দত্ত-র প্রদত্ত বিশেষণ। পুলিনবিহারী সেন রবীন্দ্রায়ণ সংকলনে (২য় খণ্ড) সন্তর্পণে গ্রন্থশেষে যে কয়েকজন প্রয়াত ব্যক্তির ‘স্মরণ’ করেছেন, তাঁদের মধ্যে রথীন্দ্রনাথ আছেন। বিশ্বভারতীর কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখে তিনি স্বেচ্ছা-নির্বাসিত। ওই সময় তাঁর অন্যতম এক সুহৃদের অনুরোধে আত্মকথা রচনা আরম্ভ করেন। তার আগে লিখেছিলেন ইংরেজি গ্রন্থটি, কিন্তু এই বাংলা গ্রন্থটি আত্মকথা নামে মুখে-মুখে সে কালে প্রচারিত হলেও আসলে কখনওই আত্মকথা নয়, গ্রন্থনাম পিতৃস্মৃতি। নিজেকে প্রায় আড়াল করে পিতার স্মৃতি চয়ন করে গিয়েছেন। কিন্তু এখানেও তাঁর জীবন প্রাধান্য পায়নি— ‘নেপথ্যচারী’ বিশেষণটি যে তাঁর প্রতি লক্ষ্য রেখেই প্রদত্ত হবে, এ কথা জানার কথা নয়; কিন্তু নেপথ্যচারিতা তাঁর স্বধর্ম ছিল, সেখান থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। এই স্মৃতিকথা শেষ হওয়ার আগেই রথীন্দ্রনাথের জীবনাবসান হয়। পরে ক্ষিতীশ রায় তার পর থেকে আরম্ভ করে শেষ করেন। কিন্তু অনুবাদ বললে কম হয়ে যায়। এমন আশ্চর্য ভাবে মিলিয়ে দিয়েছিলেন, পড়লে বোঝা যায় না।
আলোচ্য সংকলনটির নাম দ্য ডায়েরিজ অব রথীন্দ্রনাথ টেগোর। মূল রচনা থেকে তরুণ বন্ধু সুশোভন অধিকারীর অনুরোধে এটি ইংরেজি অনুবাদে রূপান্তরিত করেছেন সুপ্রিয়া রায়। দিনলিপির সূচনা ১৯০৩-এ, শেষ হয়েছে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে পিতার সঙ্গে ইতালি ভ্রমণ দিয়ে। এর পরবর্তী অংশ দিনলিপিতে অনুপস্থিত। সংকলনের সূচনাতেই অনুবাদক বলেছেন, বৃহত্তর পাঠকদের স্বার্থে এগুলি অনুবাদ করা হয়েছে। এখানেই কয়েকটি প্রশ্ন। এই বৃহত্তর স্বার্থ কতদূর প্রসারিত? কত জন পাঠক রথীন্দ্রনাথের বাংলা রচনা পড়েছেন? ইংরেজি অনুবাদের পাঠক কতদূর প্রসারিত? পিতা রবীন্দ্রনাথের বাংলা রচনাসমুদ্রে কত জন বাঙালি পাঠক অবগাহন করেছেন! আর তাঁর ইংরেজি রচনা দু’-একটি গ্রন্থ ছাড়া কত জন বাঙালি পড়েছেন!
এখানে বাংলা দিনলিপির কোনও কোনও অংশ বাদ পড়েছে দেখা যায়। রথীন্দ্রনাথ কোনও কোনও সময় পিতার ভ্রমণের সময় ব্যস্ত থাকতেন স্বাভাবিক কারণেই— কর্মবিবরণ বাদ পড়ার কারণ এটিই। সংকলনের সূচনায় অনুবাদক রথীন্দ্র-জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন, আর শেষে আছে কয়েকজন গুণী ব্যক্তির সঙ্গে তিনটি আলোচনা-সংকলন। রথীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মের ইতিহাস কম বিচিত্র নয়। তাঁর জীবনের বেশির ভাগই পিতার আদর্শ রূপায়ণে নিবেদিত হয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এ-সমস্তই তো অনুবাদকের জানার কথা। ইতিহাসটি থাকলে সেই নেপথ্যচারী প্রতিভাবানকে এ কালের পাঠকের কতকটা কাছাকাছি আনা যেত। রথীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের বড় অংশ শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের কাজে ব্যয় করেছেন। খণ্ডিত হলেও ব্যক্তি-রথীন্দ্রনাথ এখানে একেবারে অনুপস্থিত নন। ১৯১২ ও ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় রথীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বভারতীর জন্যে অর্থ সংগ্রহ করছিলেন, ওই সময় যে রাষ্ট্রশক্তির অলক্ষ টানাপড়েন চলেছিল মোটামুটি তার একটা স্পষ্ট ছবি এই দিনলিপির মধ্যে পাওয়া যায়। এই বর্ণনাসমূহ বর্তমান সংকলনের মাত্রা বাড়িয়েছে।
রথীন্দ্রনাথ যথারীতি নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখেছেন। কিন্তু পিতার উদ্দেশ্য, মানুষের সম্বন্ধে তাঁর নিজের বিচার লিখতে কোনও দ্বিধা করেননি। এ ছাড়া ফ্রান্স, হল্যান্ড, ইতালিতে রবীন্দ্রনাথ যে-সমস্ত বক্তৃতা দেন, সেগুলির সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যবহুল বর্ণনা দিনলিপির মধ্যে পাওয়া যায়। জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে যে নির্মম গণহত্যা হয়, তার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক অভিযোগও এখানে পাওয়া যাচ্ছে।
হীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন, ‘মনে আছে একবার তাঁর চামড়ার কাজ আর কাঠের কাজের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন— জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের; কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের; কথা ক’টি শুনতে বড়ো ভালো লেগেছিল।...’ এই বিচার রথীন্দ্রনাথ লিখিত ভাবেও পরে রেখে গিয়েছেন।
সুপ্রিয়া রায়ের এই অনুবাদ অখণ্ড প্রতিচ্ছবি নয় অনেকাংশ সম্পাদিত, কিন্তু কেন এ ভাবে সম্পাদনা করেছেন, তার কোনও যুক্তি দেখাননি— এইখানেই এর দুর্বলতা। রথীন্দ্রনাথের অনবদ্য গদ্যরীতি— বিশেষ করে বাংলা, তিনি স্মরণে রাখেননি। আর সংকলক অবশ্যই বিশ্বভারতী রবীন্দ্রভবনের প্রতি কৃতজ্ঞ এই কাজে অনুমতির জন্য। সে ক্ষেত্রে গ্রন্থ প্রকাশের নিয়ম অনুযায়ী যে শর্ত, সেটি তাঁর জানার কথা। প্রকাশকের কাছে একটিই অনুযোগ— এমন একটি বইয়ে এ ভাবে আলোকচিত্র ছেপে সংকলনটির মুদ্রণসৌকর্য কতটা হানি করলেন।
জীবনের শেষ সীমায় রথীন্দ্রনাথ তখন স্বাভাবিক ভাবেই ক্লান্ত। শান্তিনিকেতনে তখন গুফত-গু-র চাপা পরিবেশ। অন্ধকার দাওয়ায় বসে তখন প্রৌঢ় পুরুষেরা একটি ব্যক্তিকে অপসারণের জন্য জটলা করেন। এর পর রবীন্দ্রনাথ গত হলেন। তাঁর একমাত্র জীবিত এবং যোগ্য পুত্রের দিকে তাকিয়ে তাঁরা হা-পিত্যেশ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন! যখন দেখলেন রথীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরার চেষ্টা করছেন, তখনই অলক্ষে বিষ ছড়াতে লাগলেন। লক্ষ্য এই সরল মানুষটির অপসারণ। রথীন্দ্রনাথ বিষয়টি ধরতে পারেননি। উত্তরায়ণের দোতলায় তখন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত্রি ‘অভিজাত’দের আড্ডা! তাস, টেবল টেনিস, বিলিয়ার্ডের শব্দ কলকল্লোলের মতো ভেসে আসে। রথীন্দ্রনাথ যখন বুঝলেন, তখন ফেরার আর কোনও পথ নেই।
সেই চরম দুর্দিনে তাঁর পাশে এগিয়ে এসে কেউ দাঁড়াননি, তা নয়। এগিয়ে এসে ঊর্ণনাভ-তন্তুতে জড়িয়ে গেলেন, আর-একটা মাত্রা যুক্ত হয়ে গেল তখন! কিন্তু সত্যিই কি মাত্রা? না অলস কুটিল আশ্রমিকদের আর-একটি খোরাক? রথীন্দ্রনাথ ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’ হয়ে ক্রমশ আকাশগঙ্গায় মিশে গেলেন? হয়তো তা নয়। ইতিহাসের পুনরাবর্তন হয়েছে, আবার তিনি স্বভূমিতে ফিরে আসছেন। |
|
|
|
|
|