|
|
|
|
বিপন্ন শিক্ষার অধিকার |
শিক্ষার্থী ৯০, একা শিক্ষক
অভিজিৎ চক্রবর্তী • ঘাটাল |
৯০ জন ছাত্রের জন্য শিক্ষক ছিলেন চার জন। শেষ দু’বছরে তিন জন অবসর নিয়েছেন। নতুন নিয়োগ না হওয়ায় এক জনই পড়াচ্ছেন ৯০ জনকে। ঘাটাল শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লছিপুর প্রাথমিক স্কুলে এই ভাবেই চলছে পঠনপাঠন। অথচ, শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী ৩১ মার্চের মধ্যেই স্কুলগুলিতে যথাযথ পরিকাঠামো গড়ে তোলার কথা ছিল। সেই সময়সীমা চার মাস পার হলেও কোথায় কী! পরিকাঠামো উন্নয়ন তো দূরের কথা, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বহু স্কুলে এখনও পর্যাপ্ত শিক্ষকই নেই। যেমন লছিপুরের স্কুলটি। আইনে যেখানে ৩০ জন ছাত্র পিছু একজন শিক্ষক থাকার কথা ছিল, সেখানে আছেন ৯০ জন ছাত্রের জন্য এক জন!
মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে কী ভাবে চলছে স্কুল?
জানা গিয়েছে, স্কুলের হাল দেখে এগিয়ে এসেছেন দুই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সাধনচন্দ্র বাগ এবং নিশিকান্ত চক্রবর্তী। বিনা পারিশ্রমিকেই তাঁরা ক্লাস নিচ্ছেন আপাতত। সাধনবাবু ওই স্কুলেরই শিক্ষক হওয়ায় মাঝে মধ্যেই ছাত্র-ছাত্রীদের টানে চলে আসেন স্কুলে। আর আসেন গ্রামেরই বাসিন্দা স্থানীয় বেলসর প্রাথমিক স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ৭৫ বছরের নিশিকান্ত চক্রবর্তী। স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক স্বপনকুমার মল্লিক জানান, স্কুলের কোনও কাজে তিনি আসতে না পারলেই তাঁদের মধ্যে যে কোনও একজন স্কুলে অবশ্যই আসেন। নিশিকান্তবাবু কথায়, “বয়সও হয়েছে। চোখে ঠিক মতো দেখতে পাই না। তবু ছাত্রদের টানেই স্কুলে আসি। যত দিন পারব আসব।” স্কুলে আসার ব্যাপারে একই রকম উৎসাহী সাধনবাবুও। |
লছিপুর প্রাথমিক স্কুলে রোজকারের ছবি। —নিজস্ব চিত্র। |
লছিপুর হাইস্কুল ক্যাম্পাসে ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় লছিপুর প্রাথমিক স্কুল। ওই স্কুলে লছিপুর ছাড়াও স্থানীয় ঈশ্বরপুর ও দাঁতিয়াড়া গ্রামের ছেলে-মেয়েরা পড়ে। ২০১১ সালেও স্কুলে ছিলেন চার জন শিক্ষক। ওই বছরেই এক শিক্ষক অবসর নেন। আবার ২০১২ সালের অগস্ট মাসে স্কুলের প্রধান শিক্ষক অবসর নেওয়ার পর স্কুলে দু’জন শিক্ষক হয়ে যায়। তখন থেকেই গ্রামের মানুষ থেকে অভিভাবকরা নতুন শিক্ষক নিয়োগের জন্য আন্দোলন করে আসছেন। এমনকী গাড়ি ভাড়া করেও ঘাটালে এসে আন্দোলন, এসআইয়ের দফতরে গিয়ে ডেপুটেশন দিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। এরই মধ্যে চলতি বছরের মার্চে স্কুলের আরও এক শিক্ষক অবসর নেওয়ার পর এখন একমাত্র ভরসা স্বপনকুমার মল্লিক। গ্রামেরই বসিন্দা তথা স্কুলের এক অভিভাবক সুনীল চক্রবর্তীর কথায়, “লছিপুরের ওই স্কুল থেকেই পড়াশোনা করে বহু ছাত্র-ছাত্রী আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একসময় স্কুলে পড়াশুনোর সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্রদের পড়াশুনোয় উৎসাহ দিতে নানা অনুষ্ঠান হত। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে স্কুলে স্থায়ী শিক্ষক বলতে মাত্র একজন। আমরা একাধিকবার স্কুলে শিক্ষক দেওয়ার দাবিতে প্রতিবাদে সরব হলেও কোনও সুরাহা হয়নি।”
স্কুলে গিয়ে দেখা গেল নিশিকান্তবাবু ক্লাসরুমের ভিতরে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন। আর স্বপনবাবু প্রাক-প্রাথমিক থেকে বাকি ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে ছেলেদের পড়া দিয়ে চলে যাচ্ছেন মিড-ডে মিলের রান্নার তদারকি করতে। প্রধান শিক্ষক স্বপনবাবু বলেন, “গ্রামবাসী থেকে অভিভাবকরা তো শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে সরব রয়েছেনই। আমিও বহুবার ঘাটাল পশ্চিম চক্রের এসআই সুজিত সামন্ত, ডিআইকে বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু যে কে সেই!” তিনি আরও বলেন, “ক্লাস ছাড়াও স্কুলের নানা কাজ যেমন সর্বশিক্ষা মিশনে স্কুলের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ টাকার হিসাব, মিড-ডে মিলে কী রান্না হবে তার হিসাব থেকে শুরু করে নিয়ম মতো প্রতি চার মাস অন্তর পরীক্ষা নিতে হয়। অতি দরকারেও ছুটি নিতে পারি না।” স্কুলে যে শিক্ষক নেই তা বুঝে যেন ‘বড়’ হয়ে গিয়েছে শির্ক্ষাথীরাও। স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র অভিজিৎ ঘোষ, প্রথম শ্রেণির ছাত্রী শ্রেয়া ঘোষ, প্রিয়ঙ্কা দলুইদের কথায়, “ক্লাসে শিক্ষক না থাকলে আমরা গণ্ডগোল না করে চুপচাপ থাকি। নিজেদের মতো করে পড়াশুনো করার চেষ্টা করি।” তবে এ ভাবে আর চুপচাপ বসে থাকতে রাজি নন এলাকাবাসী। গ্রামের বাসিন্দা শান্তি চক্রবর্তী, পঙ্কজ বাগ, কার্তিক মাল, জগন্নাথ কালসার, শম্ভু রায়েদের হুঁশিয়ারি, চার মাসের আন্দোলনেও কোনও ফল হল না। সমস্যার সমাধান না হলে তাঁরা বৃহত্তর আন্দোলনে নামবেন।
সমস্যার কথা মানছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা স্কুল পরিদর্শক (প্রাথমিক) উত্তম ত্রিপাঠীও। তিনি এই সমস্যার জন্য দায়ী করছেন বদলি নীতিকেই। তবে তাঁর আশ্বাস, “ভোট প্রক্রিয়া মিটে গেলেই লছিপুর প্রাথমিক স্কুলে নতুন শিক্ষক দেওয়া হবে।” |
|
|
|
|
|