দার্শনিক লুডউইগ উইটগেনস্টাইন সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত। তাঁহার এক ছাত্র তাঁহার সহিত সান্ধ্যভ্রমণে বাহির হইয়াছিলেন। দীর্ঘক্ষণ একটিও কথা না বলিয়া কাটিবার পরে নীরবতাজনিত অস্বস্তি দূর করিবার জন্য সে দিনের আবহাওয়া সম্পর্কে ছাত্র এক মামুলি মন্তব্য করেন। উইটগেনস্টাইন তাৎক্ষণিক জবাব দেন, ‘কথা কি বলিতেই হইবে? চুপ করিয়া থাকিতে পারো না?’ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতে বসবাস করিলে তিনি কী বলিতেন, তাহা কল্পনারও অতীত। বারো মাস ত্রিশ দিন সবাই অহোরাত্র কথা বলিয়া চলিয়াছেন। কে কোন বিষয়ে কথা বলিবার অধিকারী, তাহার বিচার নাই। কোন কথার অর্থ আছে, কোন কথা অর্থহীন, ভাবিবার প্রয়োজন নাই। কোন কথা জনসমক্ষে উচ্চারণীয় নয়, কোন কথা জনান্তিকেও বলা চলে না, কোন কথা এমনকী ভাবা অনুচিত, তাহা বিবেচনার দায় নাই। কেহ পুলিশকে বোমা মারিবার পরামর্শ দিতেছেন। কেহ দারিদ্রসীমা সংক্রান্ত বিতর্কের মীমাংসা করিয়া বুঝাইয়া দিতেছেন, বারো বা পাঁচ টাকায় যথেষ্ট খাবার পাওয়া যায়। কেহ বা ভারতরত্ন প্রাপকের উপর কুপিত হইয়া তাঁহার খেতাব ফিরাইয়া লইবার সতর্কবাণী অথবা হুমকি জারি করিতেছেন। আকথা-কুকথার মহাপ্লাবন। সৌজন্য ডুবু-ডুবু, সভ্যতা ভাসিয়া যায়।
প্রশ্ন উঠিবে, অতিকথন আর অপকথন কি এক? অনেক বেশি কথা বলিলেই অনেক কুকথা বলিতে হইবে, তাহা কে বলিল? প্রশ্নটি অযৌক্তিক নহে। বিস্তর ‘ভাল কথা’ও যে সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে বলিয়া চলা যায়, তাহা বাঙালি অন্তত বিলক্ষণ জানে, প্রায় যে কোনও সভায় যে কোনও বক্তৃতা তাহার উজ্জ্বল নিদর্শন, বিশেষত সেই বক্তৃতা যদি ‘রবীন্দ্রনাথ যে পথে গিয়াছেন, আমাদেরও সেই পথে যাইতে হইবে’ বলিয়া শুরু হয়। কিন্তু সম্ভবত সুবাক্য অপেক্ষা কুবাক্যের আকর্ষণ অধিক, অতএব জনপরিসরে কথার পরিমাণ যত বাড়িতেছে, গলার আওয়াজ যত চড়িতেছে, বক্তব্যের গুণমান তত পড়িতেছে। নিজের বক্তব্য জনসমক্ষে জাহির করিবার তাগিদ এত বেশি যে, কী বলিলে এবং কত জোরে বলিলে লোকে তাহা শুনিবে ও তাহা লইয়া আলোচনা করিবে, ইহাই প্রধান লক্ষ্য। প্রচারমাধ্যমের বিপুল ব্যাপ্তি এই লক্ষ্য পূরণের অভূতপূর্ব সুযোগ আনিয়া দিয়াছে। একই সঙ্গে, সস্তায় বাজিমাত করিবার সুযোগও।
এই অতিকথনকে ‘তর্কশীলতা’ বলিয়া ভুল করিবার কোনও কারণ নাই। তর্ক অন্য বস্তু। তর্কশীল মানুষ অন্যের কথা মন দিয়া শোনে এবং আপন কথা যুক্তি দিয়া বলে। যুক্তি দাবি করে সংযম। অতিকথন যথার্থ তর্কের বিপরীত, বস্তুত শত্রু। বিবিধ সমকালীন প্রসঙ্গে এই সত্য অতিমাত্রায় প্রকট হইয়াছে। রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন দীর্ঘ হইতে দীর্ঘায়িত হইয়াছে, বিভিন্ন দিক হইতে সেই উপলক্ষে কত অর্বুদ বাক্য ব্যয় হইয়াছে তাহার কোনও ইয়ত্তা নাই। কিন্তু পঞ্চায়েত ব্যবস্থার গুণাগুণ বা কার্যকারিতা লইয়া যথার্থ কোনও আলোচনা কেহ ইত্যবসরে এক বারও শুনিয়াছেন কি? কিংবা, দারিদ্রসীমার পরিমাপ লইয়া যুক্তিতর্কের বিস্তর অবকাশ আছে, কিন্তু চলিতেছে তেত্রিশ টাকার মানিঅর্ডার, কিংবা বারো (অথবা পাঁচ) টাকায় মধ্যাহ্নভোজের ফিরিস্তি। উইটগেনস্টাইন তাঁহার এক গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখিয়াছিলেন, ‘যাহা বলা যায়, তাহা প্রাঞ্জল ভাবে বলা যায়, এবং যে বিষয়ে বলা সম্ভব নহে, সে বিষয়ে নীরব থাকা বিধেয়।’ সবই যদি বলা যায়, তবে কী করিতে হইবে, তিনি অবশ্য সে কথা বলিয়া যান নাই। |