বিচ্ছিন্নতাবাদের মূলে যে প্রায়শই স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিহিত থাকে, ভারতীয় রাজনীতিতে বারংবার তাহা লক্ষ করা গিয়াছে। কোনও জনগোষ্ঠী কিংবা জাতিসত্তা আত্মশাসন অর্জনের দাবি তোলে, সেই দাবি ক্রমাগত প্রতিহত হইতে থাকে, অতঃপর আসে বিচ্ছিন্নতার, সার্বভৌমত্বের দাবি। সেই দাবিতে আন্দোলন যখন হিংসাত্মক হইয়া ওঠে, নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যায়, তখনই শাসকদের টনক নড়ে। আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের আলোচনায় ডাকা হয়, স্বশাসনের খুঁটিনাটি লইয়া দরকষাকষি চলে এবং স্বশাসিত পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ও তহবিল অন্তরিত হয়। জম্মু-কাশ্মীর প্রদেশের লাদাখ অঞ্চলে এই স্বশাসনের দাবি দীর্ঘ দিনের। রাজ্য সরকার অঞ্চলের লেহ্ ও কার্গিল জেলার জন্য স্বশাসিত পরিষদ আগেই গঠন করিয়াছে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী এই দুই জেলার পুলিশ প্রশাসনকেও শ্রীনগরের নিয়ন্ত্রণ হইতে মুক্তি দিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন, যাহাতে এই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করিতে চার শত কিলোমিটার পথ অতিক্রম করিয়া পুলিশকে যাতায়াত করিতে না হয়। লাদাখের জনসাধারণ খুশি।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের দাবি লেহ্র বৌদ্ধরা ও কার্গিলের মুসলিমরা যৌথ ভাবেই করিয়াছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যত্র যখন বৌদ্ধ বনাম মুসলিমদের দ্বন্দ্ব তিক্ত হানাহানিতে বিস্ফোরিত, বুদ্ধগয়ার বোধিমন্দিরে সন্ত্রাসবাদী হামলার জন্য যখন ‘ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন’-এর মতো মুসলিম জঙ্গি সংগঠনকে দায়ী করা হইতেছে, তখন লাদাখের এই ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ। কার্গিল ও লেহ্ উভয়েই অবশ্য শ্রীনগরের কাছে আরও স্বশাসন চাহিয়াছে। যেমন দুই অঞ্চলেরই দাবি, এই দুই জেলা লইয়া একটি স্বতন্ত্র ডিভিশন গড়া হউক। তাহাতে প্রশাসনের অন্যান্য বিষয়েও আর এই এলাকার মানুষদের শ্রীনগরের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে হইবে না। লাদাখের দুই জেলাই এখনও কাশ্মীর ডিভিশনেরই অন্তর্ভুক্ত। পৃথক ডিভিশন হইলে লাদাখিদের আত্মশাসন আরও কিছু দূর অগ্রসর হইতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা এখনই অতটা উদার হইতে নারাজ। তবে এ ব্যাপারে শ্রীনগর উপত্যকার হুরিয়ত নেতারা রীতিমত খড়্গহস্ত। কট্টরপন্থী হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি তো লাদাখকে স্বশাসন মঞ্জুর করার প্রস্তাবকে জম্মু-কাশ্মীরকে বিভক্ত করার ‘শয়তানি চক্রান্ত’ আখ্যা দিয়াছেন। এই হুরিয়তই কিন্তু এত কাল কাশ্মীরের সার্বভৌমত্বের দাবিতে শ্রীনগর উপত্যকায় নিয়মিত আগুন জ্বালাইয়া আসিয়াছে। কাশ্মীর বলিতে হুরিয়ত গোটা রাজ্যকেই বুঝাইয়াছে, যদিও জম্মুর হিন্দুরা কিংবা লাদাখের বৌদ্ধরা কেহই হুরিয়ত প্রস্তাবিত স্বতন্ত্র, স্বাধীন কাশ্মীরের বাসিন্দা হইতে কখনও বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখান নাই।
আজ সম্ভবত হুরিয়ত নেতৃত্ব উপলব্ধি করিতেছেন, লাদাখ ও জম্মুকে বাদ দিয়া যেটুকু ভূস্বর্গ পড়িয়া থাকে, তাহা লইয়া বেশি দূর অগ্রসর হওয়া কঠিন। তাই গিলানিরা লাদাখের স্বশাসনের সম্ভাবনাকে ‘চক্রান্ত’ বলিতেছেন। কিন্তু গিলানিরা যদি ভারতের সহিত থাকিতে না চান, তবে লাদাখিরাও গিলানিদের সহিত থাকিতে না-চাহিতে পারেন। তাঁহারা যে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে লীন হইতে আদৌ উৎসুক নহেন তাহা তো বহু বার তাঁহারা জানাইয়াই দিয়াছেন। লাদাখিদের এই স্বাধিকারপ্রমত্ততাকে ‘চক্রান্ত’ বলাও সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, কারণ এ অধিকারও তাঁহাদের মৌলিক এবং জন্মগত। ইহার ঔচিত্য লইয়া প্রশ্ন তোলা তাঁহাদের পছন্দের স্বাধীনতাকে অসম্মান করারই শামিল। গিলানিরা বরং ভাবিয়া দেখিতে পারেন, কেন কার্গিলের মুসলিমরাও লেহ্র বৌদ্ধদের সহিত যৌথ ভাবে কাশ্মীর ডিভিশন হইতে স্বাতন্ত্র্য চাহিতেছেন, কেন তাঁহারা উপত্যকার সমধর্মীদের সাংস্কৃতিক নৈকট্য বা প্রশাসনিক সাহচর্য প্রত্যাখ্যান করিতেছেন! |