|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
করাচিতে বসে যেন দাউদকে দেখলাম |
এমনই অনবদ্য হোমওয়ার্ক। লিখেছেন সুমন দে |
গোটা পৃথিবীর জল্পনা উসকে দিয়েছিল তিনটে শব্দ। ‘সব আয়ে হ্যায়’।
বক্তা, জাভেদ মিঁয়াদাদ। স্থান, গ্র্যান্ড হায়াত, দুবাই। তারিখটা ২৩ জুলাই, ২০০৫। উপলক্ষ মিঁয়াদাদ-পুত্র অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্র জুনেইদ-য়ের সঙ্গে মেহজাবেন-য়ের কন্যা লন্ডনে পাঠরতা মাহরুখ-এর নিকাহ-র রিসেপশন।
মাহরুখের বাবার নাম দাউদ ইব্রাহিম কাসকর। এলাহি আয়োজনের মাঝে অতিথি আপ্যায়ন করতে করতে মিঁয়াদাদ জানিয়েছিলেন, দু’পক্ষের আত্মীয়-কুটুমরা সবাই হাজির হয়েছেন শুভকাজে। আর তাতেই মুহূর্তে ঘটেছিল জল্পনার বিস্ফোরণ। তবে কি ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল দাউদ ইব্রাহিমও উপস্থিত ভোজসভায়? স্ববেশে না ছদ্মবেশে? নাকি হোটেলেরই কোনও গোপন কক্ষে আইএসআই-য়ের নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে হাজারো সিসিটিভি ক্যামেরার আউটপুট ‘অনলাইন’-এ উপভোগ করছেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের বেতাজ বাদশা?
পৃথিবীব্যাপী বহুচর্চিত এই বিয়ের অনুষ্ঠান থেকেই শুরু হচ্ছে নিখিল আডবাণীর স্পাই থ্রিলার ‘ডি-ডে’। এর আগে ‘কাল হো না হো’, ‘সালাম-এ-ইশক’ বা ‘চাঁদনি চক টু চায়না’-র মতো বড় বাজেটে বড় তারকাদের নিয়ে ফিল্ম বানাতে অভ্যস্ত নিখিলের এই নতুন ছবিটিকে ১৯৮৬-র অস্ট্রেলেশিয়া কাপে চেতন শর্মার শেষ বলে জাভেদ মিঁয়াদাদের ছক্কার পাশেই একমাত্র রাখা যায়, কারণ মুক্তি পেতে না পেতেই এ ছবির তুলনা করা হচ্ছে ‘জিরো ডার্ক থার্টি’-র মতো মাইলস্টোনের সঙ্গে।
এই বিয়েকে কেন্দ্র করে কয়েক মাসের মধ্যেই আরেকটি খবর সর্বভারতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হতেই বেশ বেকায়দায় পড়েন ভারতীয় কূটনীতিকরা। রিসেপশনের দিনই নাকি দাউদকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার ছক কষেছিল ‘র’ এবং মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের কিছু শীর্ষ অফিসার। এই পরিকল্পনার কথা ঘুণাক্ষরেও জানতে দেওয়া হয়নি আইবি-কেও। দাউদকে সরাতে নাকি কাজে লাগানো হয়েছিল ছোটা রাজনকে। রাজনও ২০০০ সালে ব্যাংককে তার উপর ডি-কোম্পানির হামলার বদলা নিতে বদ্ধপরিকর ছিল। রাজন গ্যাং-য়ের দু’জন শার্প শু্যটারকে বাংলাদেশ বর্ডার পার করিয়ে এ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনার ভিতর দিয়ে ভারতে ঢোকানো হয় এবং দিল্লি পাঠানো হয়। প্ল্যানমাফিক আইবি-র এক অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষকর্তাকে দিয়ে তাদের ট্রেনিং দেওয়ানো হয় এই বিশেষ অপারেশনের জন্য। শেষ পর্যন্ত অবশ্য উঁচু মহলের তীব্র আপত্তি এবং ভারতীয় এজেন্সিগুলির পারস্পরিক সমন্বয়ের অভাবে এই পরিকল্পনাটি নাকি ভেস্তে যায়। |
|
ডি ডে
ঋষি, অর্জুন, ইরফান |
এই ফিল্মে অবশ্য ভারতীয় এজেন্টদের সংখ্যা চার, যাদের লক্ষ্য এ ছবির দাউদ ইকবাল ‘গোল্ডম্যান’ শেঠকে জ্যান্ত ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। প্রথমেই বলতে হয় ওয়ালি খানের ভূমিকায় ইরফান খানের কথা। ‘র’-র চর হিসেবে পাকিস্তানে এক দশক কাজ করে ‘ছুটি’ পাওয়ার মুহূর্তে এই শেষ অ্যাসাইনমেন্টটি পায় ওয়ালি। প্রত্যেকটা দৃশ্যে, প্রত্যেকটা ফ্রেমে, এমনকী সংলাপহীন মুহূর্তেও চোখ আর মুখের প্রত্যেকটি পেশি দিয়ে যে অভিনয়টা আগাগোড়া করে গেলেন ইরফান, আন্তর্জাতিক মানের যোগ্যতার স্বীকৃতি হিসেবে হলিউড থেকে তাঁর আরও ডাক পাওয়াটা অনিবার্য।
আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল দেড় দশক আগে এই কলকাতায় আলাপ হওয়া এমনই এক ‘র’ এজেন্টের কথা, যিনি পাকিস্তানে কাটিয়েছেন একটি দু’টি নয়, দীর্ঘ কুড়িটি বছর। অবসর নেওয়ার পর কলকাতারই এক প্রাক্তন কর্নেলের চর্মশিল্প সামগ্রীর দোকানে কাজ করে রাতে ফিরতেন পার্ক সার্কাসে তাঁর ছোট্ট ডেরায়। সেই প্রথম বার বুঝেছিলাম গুপ্তচরেরা মোটেই সিনেমার জেমস বন্ডের মতো হন না, দ্বিতীয় বার বোঝালেন ইরফান তাঁর অভিনয়ের নিখুঁত সাধারণত্বে, স্বাভাবিকত্বে।
প্রাক্তন ফৌজি রুদ্রপ্রতাপ সিংহের ভূমিকায় অর্জুন রামপাল নিঃসন্দেহে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভূমিকায়। ‘র’ প্রধান অশ্বিনী রাও-এর ভূমিকায় নাসের এবং ছবির দাউদের স্যাডিস্ট ভাগ্নের ভূমিকায় চন্দন রায় সান্যাল দর্শকদের সবটুকু মনোযোগ কেড়ে নেন। এবং অবশ্যই ঋষি কপূর, এ ছবিতে যাঁকে দেখে সত্যিই আপশোস হয়, এমন শক্তিশালী অভিনেতাকে গোটা সত্তর আশির দশক জুড়ে কীভাবে ‘লাভার বয়’ সাজিয়ে অপচয় করল মুম্বই ইন্ডাস্ট্রি।
ইরফান আর ঋষির অভিনয় যদি নিখিলের ছবির হৃদয় আর মস্তিষ্ক হয়, তাহলে তিন অভিনেত্রীর কাজ নিঃসন্দেহে এই ছবির মেরুদণ্ড। কাজকে বৈবাহিক সম্পর্কের ওপরে রাখা ‘র’-য়ের এজেন্ট হিসেবে হুমা কুরেশি, পাক দেহপোজীবিনী হিসেবে কমল হাসন-কন্যা শ্রুতি হাসন এবং ইরফানের স্ত্রীর ভূমিকায় শ্রীস্বরার ‘ন্যাচারাল অ্যাক্টিং’ আগাগোড়া ছবিটিকে ধরে রেখেছে।
ষষ্ঠ ছবিতে নিখিলের উচ্চ মার্গের কিছু ‘টাচ’ তাঁর উপর দর্শকদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিতে বাধ্য। ‘ম্যাডাম’-এর জরুরি ডাকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ছুটে যাওয়া কিংবা ইকবালের সংলাপে বেশ কয়েক টুকরো বিশুদ্ধ মরাঠি শব্দের অনুপ্রবেশের উদাহরণ দেওয়াই যায়। সব চেয়ে বড় কথা, পাকিস্তানে পালটা নাশকতায় ভারতও পিছপা নয় বা ভাড়াটে ঘাতক ও চররা বিপাকে পড়লে দিল্লির কর্তাদের তাদের চিনতে অস্বীকার করা বা মেরে ফেলার হৃদয়হীন কূটনীতির স্পষ্ট প্রদর্শন কয়েক বছর আগেও ভারতীয় ছবিতে ভাবাই যেত না। পরিচালকের পাশাপাশি অবশ্য চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতা রিতেশ শাহ, সুরেশ নাইয়ার, নিরঞ্জন আয়েঙ্গারদের সাধুবাদ দিতেই হয়। মনোজকুমার মার্কা বা হালের ‘গদর’ সুলভ চেনা দেশাত্মবোধক সংলাপকে সচেতন ভাবে আগাগোড়া এড়িয়ে চলার জন্য। শঙ্কর এহসান লয়ের সাউন্ডট্র্যাকের সেরা উপহার ‘আলবিদা’ সন্দেহ নেই।
ইদানীং বহু হিন্দি ছবি একটি জন্মত্রুটি বহন করছে, দৈর্ঘ্য। এত কিছু ভোলার পরও বলতে হয়, যথার্থ সম্পাদনা ‘ডি-ডে’ কে আরও নির্মেদ করতে পারত। ছবির শেষ দৃশ্যগুলিতে পুরো ফিল্মে না থাকা অতি নাটকীয়তা এড়িয়ে যদি আরও একটু বাস্তবধর্মী করা যেত (‘র’ প্রধানের সশরীরে সীমান্তে হাজির হওয়াটুকু বাদ দেওয়া ইত্যাদি) তবে নিখিলকে তাঁর এই ষষ্ঠ সন্তানটির জন্য ফুলমার্কস দিতেও আমার হাত কাঁপত না।
ইন্টারনেট বলছে, এ ছবির শ্যুটিং-য়ের প্রায় পুরোটাই হয়েছে সেটের ভিতর। সে ক্ষেত্রে পরিচালক ও শিল্প নির্দেশক যে শুধু করাচির অবিকল অ্যাম্বিয়েন্স তৈরির জন্য বাহবা পাবেন তা নয়, প্রেডি স্ট্রিটের এমপ্রেস মার্কেটের প্রতিকৃতিও হুবহু ফুটে উঠেছে পর্দায়। ১৮৮৯ সালে জেমস স্ট্রাচানের ডিজাইনে তৈরি করা প্রকাণ্ড ভিক্টোরিয়ান গথিক স্থাপত্যটিকে নিখিলের ফিল্মে দেখে কে বলবে গোটা মহল্লাটাই সেটে বানানো!
সাত বছর আগের এক পড়ন্ত বিকেল। করাচির নাপিয়ের রোড ধরে এগোচ্ছি। কানে এল চেনা বলিউডি সুর ‘কজরা রে’। গাড়ির চালককে জিজ্ঞাসা করতে বলল, মুজরার প্রস্তুতি চলছে। পাকিস্তানে আইনত দেহ ব্যবসা নিষিদ্ধ হলেও মুজরার আড়ালেই চুটিয়ে চলে পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা। ‘ডি-ডে’ তে অর্জুন রামপাল ও শ্রুতি হাসনের দৃশ্যগুলিতে হুবহু উঠে এসেছে সেই নাপিয়ের রোড। এমনকী, ভারতীয় বুঝতে পেরে পর্দায় শ্রুতি হাসনের প্রথম প্রতিক্রিয়া সেই সাত বছর আগে ভারতীয় সাংবাদিকের কানে ভেসে আসা ‘কজরা রে’!
হলে বসে চমকে উঠেছিলাম। সামলে উঠে মনে মনে কুর্নিশ করলাম নিখিলের হোমওয়ার্ককে। সাবাশ! |
|
|
|
|
|