খাদ্য সুরক্ষা অর্ডিন্যান্স জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার গণবণ্টন ব্যবস্থায় যে আমূল পরিবর্তন আনছে, গোড়ায় আপত্তি থাকলেও তা প্রাথমিক ভাবে মেনে নিচ্ছে রাজ্য সরকার। বৃহস্পতিবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এই সংক্রান্ত এক বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে বলে সরকারি সূত্রের খবর। কেন্দ্রের আইন মানলে সরকারের ঘাড়ে প্রায় কোনও বাড়তি বোঝা চাপবে না বলেই প্রাথমিক আপত্তি সরিয়ে সরকার খাদ্য সুরক্ষা দিতে রাজি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারের এক কর্তা।
আইন মেনে আগামী ৬ মাসের মধ্যে খাদ্য সুরক্ষা চালু করার জন্য কেন্দ্রের নির্দেশিত পথে প্রাথমিক কাজ শেষ করবে রাজ্য সরকার। খাদ্য দফতরের এক কর্তা জানান, কেন্দ্রীয় সরকারের সমীক্ষা অনুযায়ী, খাদ্য সুরক্ষার আওতায় আসবেন এ রাজ্যের ৬ কোটি ৩৭ লক্ষ মানুষ। কেন্দ্রীয় আইনে এই জনসংখ্যাকে ‘অগ্রাধিকারে থাকা গৃহস্থালি’ (প্রায়োরিটি হাউসহোল্ড) বলা হয়েছে। এখন রাজ্য সরকারের প্রাথমিক কাজ হবে, ওই সংখ্যক মানুষকে চিহ্নিত করা। কেন্দ্রীয় আইনে এই ধরনের পরিবারগুলিকে মাসে মাথাপিছু ৩ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি চাল বা ২ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি গম দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অম্ত্যোদয় পরিবারগুলি (হতদরিদ্র বলে চিহ্নিত যারা) ওই একই দামে মাসে ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য পাবে।
এখন রাজ্যে জঙ্গলমহল, আয়লা দুর্গত ও বন্ধ চা বাগান এলাকায় ২ টাকা কেজি দরে মাথাপিছু মাসে পাঁচ কেজি চাল দেওয়া হয়। পাশাপাশি সেই খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য পরিবহণ খরচ এবং রেশন দোকান মালিকদের কমিশন দিতে হয় রাজ্যকেই। সব মিলিয়ে রেশন ব্যবস্থা চালু রাখতে সরকারের এখন বছরে প্রায় ৬৯৫ কোটি টাকা খরচ হয়। কেন্দ্রের নতুন আইনে ৬ কোটি ৩৭ লক্ষ অগ্রাধিকারে থাকা গৃহস্থালিতে খাদ্য পৌঁছে দিতে বছরে গড়ে ৭০০ কোটি টাকা খরচ হবে রাজ্যের। অর্থাৎ কেন্দ্রের আইন কার্যকর করলে এই বাবদ প্রায় কোনও বাড়তি আর্থিক বোঝা সরকারের ঘাড়ে চাপবে না এবং সে কারণেই প্রাথমিক ভাবে আপত্তি থাকলেও এখন কেন্দ্রের আইন মেনে নেওয়া হচ্ছে বলে জানান খাদ্য দফতরের ওই কর্তা।
সরকারি সূত্রের খবর, রাজ্যে বর্তমানে রেশন কার্ডধারী বাসিন্দার সংখ্যা ৯ কোটি ১৩ লক্ষ। এর মধ্যে ৬ কোটি ৩৭ লক্ষ লোক খাদ্য সুরক্ষার আওতায় চলে আসবেন। বাকি ২ কোটি ৭৬ লক্ষ লোক রেশনে খাদ্যশস্য পাবেন কি না, তা এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি রাজ্য। খাদ্য দফতরের এক কর্তা জানান, আপাতত ৬ কোটি ৩৭ লক্ষ লোকের ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাকিদের বিষয়ে এ দিনের বৈঠকে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে রাজ্য এ নিয়ে চিন্তিত। কারণ এই ২ কোটি ৭৬ লক্ষ লোকের জন্য কেন্দ্র কোনও ভর্তুকি দেবে না। এদের রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য দিতে গেলে রাজ্যকেই বাজার দরে চাল-গম কিনে তা সরবরাহ করতে হবে। তখন ওই খাদ্যশস্য পরিবহণের খরচ এবং সেই বাবদ দোকান মালিকদের কমিশনের ভারও রাজ্যকেই বইতে হবে। সব মিলিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার বোঝা চাপবে তাদের ঘাড়ে। খাদ্য দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, রাজ্য এই দায় বহন করতে সক্ষম নয়।
বর্তমানে রাজ্যে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে গড়ে সাড়ে ৪২ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বণ্টন করা হয়। কিন্তু খাদ্য সুরক্ষা আইন কার্যকর হলে আগামী দিনে কেন্দ্রের তরফে রাজ্যকে সাড়ে ৩৬ লক্ষ খাদ্যশস্য দেওয়া হবে। ফলে প্রতি বছর প্রায় ৬ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য কম পাবে রাজ্য। মহাকরণ সূত্রের খবর, আপাতত কোনও সিদ্ধান্ত না হলেও খাদ্য সুরক্ষা থেকে বাদ পড়ে যাওয়া লোকেদের জন্য বাড়তি খাদ্যশস্যের খরচ দিতে কেন্দ্রকে বলবে রাজ্য। যদিও কেন্দ্রীয় খাদ্য মন্ত্রক ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, কোনও রাজ্য রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য সকলকে খাদ্যশস্য দিতেই পারে। কিন্তু কেন্দ্র তার নেবে না। খাদ্য সুরক্ষা আইন নিয়ে আলোচনার শুরুতেই একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, এই আইন কার্যকর হলে বর্তমান রেশন ব্যবস্থার বিপুল বদল হবে এবং বহু লোক রেশন ব্যবস্থার আওতার বাইরে চলে যাবেন। বিরোধীরা তখনই এ নিয়ে সরব হয়। জটিলতার আশঙ্কায় এ বছরের শুরুতে সব রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী কে ভি টমাস। তখনই খাদ্য সুরক্ষা আইনের বিরোধিতা করে রাজ্য। যদিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আপাতত ৬ কোটি ৩৭ লক্ষ পরিবার চিহ্নিত করার কাজেই মনোনিবেশ করছে রাজ্য। |