সে যুগে রাজকোষ খুলিয়া রাজা বলিতেন, দাও, উহাকে খুশি করিয়া দাও! রাজমহিমা প্রদর্শনের গল্পটি অবশ্য সাধারণত ওইখানেই শেষ হইত, রাজা আর ‘উহার’ খোঁজখবর করিতেন না, ‘উহার’ হইতে কিছু প্রত্যাশাও করিতেন না। কিন্তু হায়, কলিকালের গণতন্ত্রে সে সুখ নাই। কোনও ব্যক্তিকে খুশি করিলে সেও উল্টাইয়া আমায় খুশি রাখিবে, এই প্রত্যাশার প্রয়োজন পড়ে, আদানপ্রদানের হিসাবটি দরকার হয়। তাই রাজকোষ খুলিয়া রাশি রাশি লোককে খুশি করিতে হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের তৃণমূলীকরণ হইতেছে সন্দেহ নাই, তাই কংগ্রেস আমলে এখানে পুরস্কারের সংখ্যা ছিল একটিমাত্র, বামফ্রন্ট আমলে তাহা বাড়িয়া হয় পঁচিশ, এবং চলমান তৃণমূল শাসনে তাহা দাঁড়ায় দুই শত’রও বেশি। বস্তুত, পুরস্কারের সংখ্যা যে হারে বাড়িতেছে, নূতন প্রাপক খুঁজিয়া পাওয়া দ্রুতই দুরূহ হইবে। তবে কি না, নূতন লোক যে লাগিবেই, এমন কী কথা আছে। পুরাতন প্রাপকদেরও নূতন করিয়া খুশি করা যায়। ‘খুশি’ তো কাহারও চিরকাল টিঁকে না!
মুখ্যমন্ত্রীর দোষ নাই। গত সাড়ে তিন দশকের বাম জমানায় গণতন্ত্রের যে বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষালাভ করিয়াছেন, তাহা এই অঙ্কই তাঁহাকে শিখাইয়াছে। ইহা কোনও ‘পরিবর্তন’ নয়, দস্তুরমত চালু প্রথার বিধিসম্মত সম্প্রসারণ। জানাইয়াছে, সরকারি পুরস্কার মাত্রেই সরকারি প্রসাদ, ইহার মধ্যে কোনও শ্রেষ্ঠত্বের বিবেচনা নাই, সুকার্যের অভিনন্দন নাই, সম্ভাবনার স্বীকৃতি নাই। কিলো-দরে যে বস্তু বিলাইয়া দেওয়া হয়, তাহার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের সন্ধান থাকিবেই বা কী করিয়া। শ্রেষ্ঠত্ব তো প্রতি বৎসরের পুরস্কারের সহিত তাল মিলাইয়া বিপুল গুণিতকে বাড়িতে পারে না। বাম শাসকরা তাই অত হ্যাপার মধ্যে না ঢুকিয়া নিজেদের পছন্দসই ও প্রয়োজনীয় মানুষগুলিকে বাছিয়া, বঙ্কিম-নজরুল উপেন্দ্রকিশোর-দীনবন্ধু লালন-ভানুভক্ত প্রমুখ বিবিধ কৃতী পুরুষের নামে পুরস্কার বিলাইতেন। বাম-শিক্ষাক্রমের সেরা ছাত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এ বিষয়েও উত্তাল দক্ষতায় সেই রাজনৈতিক অনুগ্রহ-বিতরণের ঘরানার বৃদ্ধি ঘটাইয়াছেন। বঙ্গভূষণ, বঙ্গবিভূষণ, সঙ্গীতসম্মান, মহাসঙ্গীতসম্মান, কৃষকরত্ন, বিডিওরত্ন ইত্যাদি তাঁহার ভাণ্ডারে উথলাইয়া উঠিতেছে। কুলোকে ফিসফিসাইতেছে, রাজকোষ হইতে নাকি পুরস্কার বাবদ বরাদ্দ হইয়াছে তিন কোটি টাকা।
প্রশ্ন উঠিতেছে, যে রাজকোষ এমনিতেই শূন্য, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যেখানে অন্যান্য প্রসঙ্গে অর্থভাণ্ডারের হাঁড়ির হাল নিয়ে উত্তেজিত বক্তৃতা দেন, সেখানে এই বিপুল বরাদ্দ আসিতেছে কী ভাবে! শিল্প-কারখানায় উৎসাহ-ভাতা মিলে না, কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতিতে পুরস্কার-ভাতার ছড়াছড়ি! এ প্রশ্ন অনর্থক। ভাতা সে দিকেই ধাবিত হইবে যে দিক হইতে গণতন্ত্রের প্রত্যাশা অর্থাৎ ভোটের ঝুলি পুরিবে। পশ্চিমবঙ্গে যে শিল্পকারখানা দিয়া ভোট হয় না, তাহা সিঙ্গুরধন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপেক্ষা কে-ই বা ভাল জানেন? আর শিল্প-সংস্কৃতি যে বাংলার মাটির ডাক, মানুষের গর্ব, ইহাও তিনি জানেন। তবে কিনা, যাঁহারা পুরস্কার লইয়া ধন্য ধন্য করিতেছেন, তাঁহাদের প্রশস্তিতে না ভুলিয়া নেত্রী এক বার খোঁজ করিয়া দেখিতে পারেন, অন্তরালে কেহ অন্তত এক জনও দাঁড়াইয়া আছেন কি না, পুরস্কার দিতে চাহিলে যিনি বলিবেন, ‘আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর।’ |