বোমাবৃষ্টি, গুলিচালনা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, নারীনির্যাতন, নরহত্যা। কোনও যুদ্ধ নহে, ভয়ানক ঘটনাগুলি ঘটিতেছে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে। উপলক্ষ পঞ্চায়েত নির্বাচন। প্রতি বছর নির্বাচনের সহিত হিংসার পরিধি বাড়িতেছে। পরিধি দুই অর্থে, স্থান ও কাল। এক দিকে হিংসার মানচিত্রে ক্রমাগত যুক্ত হইতেছে নূতন নূতন অঞ্চল। বাঁকুড়ার জয়পুর-কোতুলপুর, বর্ধমানের মন্তেশ্বর, হুগলির আরামবাগ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী-ক্যানিং সন্ত্রাস কবলিত বলিয়া চিহ্নিত হইয়াছে আগেই। এ বার তাহাদের সহিত যোগ দিয়াছে উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙা, কোচবিহারের দিনহাটার নানা অঞ্চল, বীরভূমের কসবা গ্রাম পঞ্চায়েত। অন্য দিকে, হিংসার কালপর্বও বাড়িয়াছে। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় হইতে প্রার্থীকে অপহরণ, বাড়ি গিয়া ভীতিপ্রদর্শন, নানা অত্যাচার শুরু হয়। আশঙ্কা, ফল প্রকাশের পরেও তাহার জের চলিবে। হিংসা কতটা ব্যাপক ও তীব্র, তাহা বুঝিতে সাধারণত মৃত্যু গণনা করা হইয়া থাকে। কিন্তু এক দিন একটি তীব্র হিংসার ঘটনা অপেক্ষা লাগাতার হিংসাকে কম ভয়াবহ মনে করিবার কারণ নাই। হিংসা একটি গোটা অঞ্চলের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে। পুরুষরা গ্রামছাড়া, শিশুরা বোমায় জখম, লুটপাটের জেরে বাড়িতে ভাতের থালাটিও নাই, এমন পরিস্থিতিতে দিনের পর দিন বাঁচিবার চেষ্টা কি মৃত্যুযন্ত্রণার সমান নহে?
পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা এ রাজ্যে নূতন কথা নহে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা লইয়া রাজ্য সরকার এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মধ্যে দীর্ঘ টালবাহানাও চলিয়াছে। কার্যক্ষেত্রে কিন্তু গ্রামবাসীকে নিরাপত্তা দেওয়া যায় নাই। সংবিধানই স্বশাসনের অধিকার দিয়াছে গ্রামের মানুষকে। বাস্তবে তাহা পাইতে কি এই মূল্য চুকাইতে হইবে? স্বশাসনের একটি আদর্শ লইয়া পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থার পত্তন হইয়াছিল। বাস্তব যে সম্পূর্ণ আদর্শ-অনুরূপ হয় না, তাহা প্রত্যাশিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাহা বিকৃত হইতে হইতে একটি ভীতিপ্রদ ব্যঙ্গচিত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কী উদ্দেশ্যে নির্বাচন, কেনই বা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, যে বিজয়ী প্রার্থী গ্রামবাসীকে ঘরছাড়া করিল, সে কী করিয়া প্রশাসন চালাইবে, লোকে সে সব কথা ভুলিয়াছে।
অপরিমিত হিংসার এই নির্বাচনকে গণতন্ত্রের শবসাধনা বলিলে ভুল হয় না। বিরোধিতাই গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। মানুষে-মানুষে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে, স্বার্থে-স্বার্থে যে সংঘাত, রাজনৈতিক বিরোধিতার মাধ্যমে তাহার মোকাবিলাই গণতন্ত্রের পদ্ধতি। এ ভাবেই গণতন্ত্র সকল গোষ্ঠী, মতকে স্থান দিতে পারে। স্থান দিবার অর্থ কেবল সহ্য করা নহে। গণতান্ত্রিক প্রশাসনে চালিকাশক্তি বিরোধীরাই। সংসদ হইতে গ্রাম পঞ্চায়েত, বিরোধী সদস্যরাই প্রশাসনের সক্রিয়তা, স্বচ্ছতা বজায় রাখিতে পারেন। অথচ গ্রামের পর গ্রাম বিরোধী-শূন্য করিয়া তোলাই এখন রাজনৈতিক দলগুলির উদ্দেশ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বিরোধীরা মনোনয়ন পেশ করিবার পূর্বেই তাঁহাদের অপহরণ করা হইতেছে। হুমকি, হামলা, লুটপাটের দ্বারা বিরোধী প্রার্থী, বিরুদ্ধ মত, দুটিকেই সম্পূর্ণ মুছিয়া দিবার চেষ্টা চলিতেছে। তাহার ফলে নির্বাচনই অর্থহীন হইয়া যাইতেছে। কোনও গ্রামে কিংবা ব্লকে কত জন ক্ষমতাসীন দলকে সমর্থন করেন না, তাহা বুঝিবার উপায় নাই যদি বিরোধী প্রার্থী না থাকে। অর্থাৎ জনমতকে মানিবার পরিবর্তে, জনমত জানিতেই না পারিবার জন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করা হইতেছে। গাছের ফল খাইয়া তাহার মূলোৎপাটন করা কেবল নির্বুদ্ধিতা নহে, দুষ্টবুদ্ধি। রাজনৈতিক দলগুলি তাহারই পরিচয় দিয়া চলিয়াছে। ভরসা কেবল ইহাই যে, প্রাণ হাতে লইয়াও গভীর রাত পর্যন্ত মানুষ ভোট দিয়াছেন। যেখানে ভোট পণ্ড হইয়াছে, সেখানেও পুনর্নির্বাচনের দিন ভোট পড়িয়াছে উচ্চহারে। সাধারণ মানুষের নীরব সংকল্পই হিংসাকে নৈতিক ভাবে পরাস্ত করিয়াছে। |