|
|
|
|
এটাই বা কম
কী |
মণিপুরে মুক্তি পায় না কোনও
হিন্দি ছবি। সেই মণিপুরেই ঘুরে গেলেন প্রিয়ঙ্কা চোপড়া। সটান মেরি কম-য়ের বাড়িতে।
তাঁর চরিত্র আরও ভাল ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে। সেই ছবি নিয়ে মেরি আড্ডা দিলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত-এর সঙ্গে |
তখন মেরির বছর আঠেরো বয়স।
অন্যান্য রবিবারের মতো সে দিনও সকালে চার্চে যাচ্ছিলেন। পরনে র্যাপঅ্যারাউন্ড।
হঠাৎ এক রিকশাচালক অসভ্যতা শুরু করে। অশালীন ভাবে মেরিকে ছুঁতে চেষ্টা করে। টিটকিরি দেয়। ভেবেছিল শান্ত মেয়েটি হয়তো নীরবে সহ্য করবে।
কিন্তু না। বক্সিং গ্লাভস হাতে না থাকলে কী হবে! মেরি গদাম করে এক ঘুসি মারেন ছেলেটিকে।
তখনও মেরিকে বক্সার হিসেবে দেশ চেনেনি। সবেমাত্র প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছেন।
এ সব ২০০১-এর কথা।
তার পর বারো বছর কেটে গিয়েছে।
অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ থেকে শুরু করে প্রিয়ঙ্কা চোপড়া অভিনীত নিজের জীবনের ওপর হিন্দি ছবি রিকশাচালককে ঘুসি মেরে শায়েস্তা করা সেই মেয়েটি আজ অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন।
দু’মাস আগে তাঁর তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয়েছে। নাম প্রিন্স। এর মাঝেই প্রিয়ঙ্কা চোপড়া ঘুরে গিয়েছেন ইম্ফলের বাড়িতে। মেরিকে আরও ভাল ভাবে বোঝার জন্য। আর তার সঙ্গে মণিপুরের সভ্যতাকেও। পুঁচকে প্রিন্সকে ঘুম পাড়িয়ে রাত ৮টা নাগাদ ফোনে কথা বলতে এলেন মেরি। “মাঝে মাঝে যখন এ সব নিয়ে ভাবি, তখন চোখে জল এসে যায়। আবার তার পরের মুহূর্তেই কী দারুণ আনন্দ হয়। আমাদের ‘কম কমিউনিটি’টা খুব ছোট। মাত্র এক হাজার মানুষ আছেন হয়তো। আর সেখানকার এক জনকে নিয়ে আজ বলিউডে ছবি হচ্ছে সঞ্জয় লীলা বনশালির প্রযোজনায়। ভাবলে কেমন একটা যেন লাগে,” বলেন মেরি। |
|
বক্সিংয়ে মেডেল আনাটা না হয় অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু হিন্দি ছবির বিষয়? সেটা তো একদম নতুন রকমের এক অভিজ্ঞতা। আরও অন্য রকম, কারণ মণিপুরে আজও হিন্দি ছবি হলে গিয়ে দেখা যায় না। যা কিছু বলিউড, তাই গোপনে দেখার রীতি সেখানে এখনও পুরোদস্তুর ভাবে মানা হয়ে থাকে। খারাপ লাগে না এ ভাবে দেশের সব থেকে বড় একটা ইন্ডাস্ট্রির কাজ প্রকাশ্যে না দেখতে পেরে? যে ইন্ডাস্ট্রির তৈরি ছবি নাকি এক অর্থে দেশের মানুষকে বেঁধে রেখেছে? একসঙ্গে তাদের কাঁদাচ্ছে, হাসাচ্ছে?
“ছোটবেলা থেকেই তো দেখে আসছি যে মণিপুরে হিন্দি ছবি হল-য়ে দেখানো নিষিদ্ধ। ইউজি (আন্ডারগ্রাউন্ড)-রা এটাই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ভিডিয়ো ক্যাসেটে হিন্দি সিনেমা আমি অনেক দেখেছি। ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’, ‘দিলওয়ালা দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’, ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’ হিন্দি সিনেমা দেখার শুরু এগুলো দিয়েই। কেব্ল টিভি আসার পর তো বিশেষ কোনও হিন্দি ফিল্ম দেখানোর অনুরোধ করলে টিভিতেও সেগুলো দেখা যায়।”
আর হিন্দি সিনেমার ভিসিডি? সেগুলো বিক্রি হয় না? “হয়। তবে গোপনে,’’ জানান মেরি।
তা হলে তো ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ দেখা হয়নি তাঁর? যে বায়োপিকটা দেখে অনেকেই প্রশ্ন করছেন প্রিয়ঙ্কা চোপড়া কি ফারহান আখতারের মতোই পরিশ্রম করে মেরির বায়োপিকে অভিনয় করবেন? “পুরো ছবিটা তো দেখিনি আমি। ‘ভাগ মিলখা ভাগ’-এর ট্রেলার দেখেছি। দেখে মনে হয়েছে ফারহান বেশ ভাল কাজ করেছে। আশা করছি যে, আমাকে নিয়ে করা ছবিটা যেন মণিপুরের মানুষ দেখতে পান।”
প্রিয়ঙ্কা ইম্ফলে আসার আগেই ছবির চিত্রনাট্য নিয়ে পরিচালক উমং কুমারের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে তাঁর। শুধু তো আর খেলার জীবন নিয়েই ছবিটা নয়। মেরির বক্সার হয়ে ওঠার যুদ্ধটাও থাকবে সেখানে। আর মেরির প্রেম? ওনলের সঙ্গে? থাকবে না মেরির প্রথম বিদেশ সফরের আগে পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছিলেন, কী ভাবে তখন তাঁকে ওনলের সাহায্য করেছিলেন? তার পর কী ভাবে মেরির বাবা ওনলেরকে মারতে ছোটেন যখন বেকার অবস্থায় মেরিকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে যান ওনলের? পুরনো কথা মনে পড়তে হেসে ওঠেন মেরি। “হ্যাঁ, সিনেমাতে আমাদের প্রেমের সম্পর্কটা দেখানো হবে। ওনলের আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ...”
স্মৃতি ভেসে আসে। কেরিয়ারের প্রথম দিকে মেরির তেমন পয়সা ছিল না। বত্রিশ ঘণ্টা বাসে করে ইম্ফল থেকে গুয়াহাটি যেতেন। তার পর সেখান থেকে ট্রেনে করে ভারতের অন্যান্য জায়গাতে যাওয়া। সবই তখন ওনলের সঙ্গে। হিন্দি সিনেমাতে ট্রেনের সফরকে কেন্দ্র করে কত গান আছে! মেরি-ওনলের প্রেমকে ঘিরেও কি সে রকমই কিছু চাইবেন দেখতে? একটু লজ্জা পেয়েই বললেন, “জানি না, হয়তো পরিচালক আরও অন্য রকম আইডিয়া নিয়ে আসবেন।”
মনে পড়ে যায় বিয়ের পরের একটি ঘটনা। তখনও মণিপুরে মেয়েদের চাকরিবাকরি করার তেমন চল ছিল না। আর মেরি সেখানে বিয়ের পরেও বক্সিং নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন। তার মধ্যেই অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকবাজদের হাতে খুন হন মেরির শ্বশুর। |
|
মেরি তাঁর তিন ছেলেকে নিয়ে ছবি তুলে পাঠালেন শুধুমাত্র আনন্দplus-এর জন্য |
অনেকের ধারণা, এ রকম একটা ঘটনার পেছনে কাজ করেছিল ঈর্ষা। মেরি-ওনলের জীবনের শান্তি নষ্ট করা হয়েছিল এটা করে। অনেকেই চাননি মেরি বক্সিং-য়ের কেরিয়ার নিয়ে বেশি দূর এগোন। আর তা আটকাতেই এ রকম একটা পদক্ষেপ। প্রথমে মেরি বেশ ধাক্কা খেয়েছিলেন। গ্লাভস ছুড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, ওনলের বোঝান যে সেটা করলে তাঁর শত্রুদেরই জিত হবে। “ওনলের আমার কান্ডারি। কত রকমের টিটকিরি শুনেছি। মা হওয়ার পরে লোকে বলত, মেরি আর বক্সিংয়ে ফিরতে পারবে না। কিন্তু আমি কোনও কিছুতেই কান দেইনি। যময দুই ছেলেকে ওনলের বাড়িতে সামলেছে। আর আমি গিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে ঘাম ঝরিয়েছি,” বলেন মেরি।
মাঝখানে এক ছেলের হার্টের একটি সমস্যা দেখা দিয়েছিল। “তখন আমি ট্রেনিং করছি চিনে। ওনলের বলত তোমাকে শক্ত হতেই হবে। কিন্তু মায়ের মন তো, আমি কী করে ওকে নিয়ে না ভেবে থাকি? একবার মণিপুরে ন্যাশনাল হাইওয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল ইউজি-র সদস্যরা। লোকাল বাজারে যেটুকু পাওয়া যাচ্ছিল তার দাম আকাশচুম্বী। এদিকে আমার বাচ্চাদের তখন বেবি পাউডার শেষ হয়ে গিয়েছে। সে সময় আমি ট্রেনিং করছি ভোপালে। বন্ধুবান্ধব, স্পনসরকে বলে বাচ্চাদের জন্য ক্যুরিয়ারে পাউডার পাঠানো হল...”
মণিপুর নিয়ে কথা হচ্ছে যখন, জানতে ইচ্ছা করে মেরির কী মতামত ইরম শর্মিলা চানুকে নিয়ে। এগারো বছর ধরে অনশন করছেন যে শর্মিলা, তার সঙ্গে কোনও দিন দেখা করেছেন তিনি? “না, আমাদের কোনও দিন দেখা হয়নি। আমি ওঁর ইচ্ছাশক্তিকে সম্মান করি। তবে আমাদের দু’জনের চিন্তাধারা স্বতন্ত্র। এত বছর ধরে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাকে আমি সম্মান করি।”
শর্মিলা প্রসঙ্গ থেকে উঠে আসে নারীশক্তির কথা। প্রগতিশীল সমাজে কেন আজও বলা হয় যে মেয়েদের পোশাক-আসাকই ধর্ষণের অন্যতম কারণ? উত্তরে জানালেন নিজের জীবনের সেই অভিজ্ঞতার কথা। “আজও মনে আছে সে দিনের কথা। যে দিন চার্চে যাওয়ার পথে একটা ছেলে আমার সঙ্গে অসভ্যতা করতে এসেছিল। প্রায় মেরেই ফেলতাম লোকটাকে সে দিন। এত সাহস যে, এ ভাবে অপমান করে আমাকে! সে দিন তো আমি ট্রাডিশনাল র্যাপঅ্যারাউন্ড পরেছিলাম। যখন এই ধরনের কথা শুনি তখন মনে হয় শুধু শুধু মেয়েদের পোশাক নিয়ে কেন প্রশ্ন তোলা হয়? অসুস্থ মানসিকতা থেকেই তো ধর্ষণ হয়,” সাফ জানিয়ে দিলেন মেরি। তার পর কথা আবার ঘুরে আসে তার সিনেমার কথা। ছবিটা কিন্তু শেষ হবে যখন মেরি পর পর পাঁচবার ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন। “লন্ডন অলিম্পিক্সের আগেই প্রথমে ছবিটার কথা শুনে হেসেই ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম কেউ ইয়ার্কি করছে। পরে আমাদেরকে একটা স্ক্রিপ্ট দেখানো হয়েছিল। প্রিয়ঙ্কা আর পরিচালককে আমি বলেছি কী ভাবে ছবিটা হলে আমার ভাল লাগবে,” মেরি জানান।
আরও বলেছিলেন যে প্রিয়ঙ্কা যেন খেয়াল রাখেন যাতে ফিল্মে ওর পোশাকে কোনও ভুল-ত্রুটি না হয়। “মণিপুরে অনেক কমিউনিটি আছে। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব এক একটা পোশাক আছে। ‘কম-কমিউনিটি’র মেয়েরা যে ধরনের র্যাপ অ্যারাউন্ড পরেন, আমি চাই ও ফিল্মে সেটাই পরুক। এ বিষয়ে কোনও ধরনের কনফিউশন হলেই বলেছি ও যেন আমাকে ফোন করে,” মেরি জানান।
ইতিমধ্যে ইম্ফলে থাকাকালীন প্রিয়ঙ্কাকে কুকি নাচের তালিমও দিয়েছেন মেরি। আচ্ছা এটা কি ঠিক যে প্রিয়ঙ্কার সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে বলিউড তারকার জীবনের সঙ্গে নিজেরও কিছু মিল পেয়েছেন? “হ্যাঁ, তা ঠিক। প্রথম যখন মুম্বইতে প্রিয়ঙ্কার সঙ্গে দেখা হয় ও আমাকে ছোটবেলার গল্প বলেছিল। ছোট থেকেই ও খেলাধুলো পছন্দ করত। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে ভালবাসত। ছেলেদের মতো পোশাক পরতেও পছন্দ করত। ভৌগোলিক দিক থেকে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছি। তবে এখানে প্রিয়ঙ্কার সঙ্গে আমি নিজের একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাই। ওর সঙ্গে মিশে মনে হয়েছে প্রিয়ঙ্কা বেশ সরল আর দয়ালু। এতেও একটা মিল রয়েছে।”
তবে প্রিয় বলিউড অভিনেতার নাম জিজ্ঞেস করলেই মেরি বেশ ডিপ্লোম্যাটিক হয়ে যান। বলেন, “সব অভিনেতা আমার প্রিয়।” তাঁর নিজের কি অ্যাকশন ফিল্ম বেশি পছন্দ? নাকি রোম্যান্স? “দুটোই পছন্দ। দুঃখের দৃশ্য হলে আজও রুমাল খুঁজি আমি!” বলেই হেসে ফেলেন মেরি। এটা শুনে অনেকেরই অদ্ভুত লাগবে জেনে মেরির পালটা প্রশ্ন, “বক্সিং করি রিং-য়ের ভেতর আর প্র্যাকটিসের সময়। তাই বলে কি আমার সূক্ষ্ম অনুভূতি নেই? আমি তো মা। আমার চোখেও জল আসে। বাড়িতে থাকলে আমি একেবারেই অন্যান্য মেয়েদের মতো। ডায়াপার বদলাচ্ছি। ছেলেদের (রেচুংবার আর খুপনেইবার) সঙ্গে গল্প করছি। ওদের মান-অভিমানের কথা শুনি। ভাল রান্না করতে পারি আমি। নিরামিষ বা আমিষ দু’টোই পারি।” জীবনে এত কিছু পেয়েও মেরি তবু স্বপ্ন দেখেন। একবারও মনে হয় না আর পাওয়ার কী রয়েছে? “আমার রাজ্যের মানুষের শুভেচ্ছা আমাকে প্রেরণা জোগায়। এই ‘কম-কমিউনিটি’র লোকেদের প্রার্থনা আমাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রিন্সকে নিয়ে আমার সারা দিন কাটছে।
|
আমি প্রিয়ঙ্কা হতে হবে মেরি |
• ফারহান আখতারকে ‘ভাগ মিলখা ভাগ’য়ে যিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন সেই
সমীরই প্রিয়ঙ্কা চোপড়াকেও কোচ করছেন
• একক প্রশিক্ষণ শিবির শুরু হয়েছে ছ’ মাস
• মেরি কমের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের কোচরাও প্রশিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন।
তাঁরাও এখন প্রিয়ঙ্কার কোচ
• মেরির প্রত্যেকটা ম্যাচের ভিডিয়ো দেখানো হচ্ছে প্রিয়ঙ্কাকে। যাতে রিংয়ের মধ্যে
তাঁর পান্চ ও ফুটওয়ার্ক নিখুঁত হয়
• সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা শিফ্টে মুম্বইয়ের স্টুডিয়োতে মেরি কম হয়ে শ্যুটিং করছেন প্রিয়ঙ্কা। তারই ফাঁকে কোচিং নিতে হচ্ছে |
|
|
|
|
|
|