স্পর্ধা বটে দুই মেয়ের! ধর্ম-সমাজ-সংসার জলাঞ্জলি। পরোয়া নেই মোল্লাদের লাল চোখকেও। আর এ সবই দুর্নিবার ভালবাসার টানে।
বাংলাদেশে দাপিয়ে বেড়ানো মৌলবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলামির আমির চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল্লামা শফি এই ক’দিন আগেই ফতোয়া দিয়েছেন “মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে থেকে আসবাব ঝাড়পোঁচ করবে, শিশুর জন্ম দেবে আর তাদের প্রতিপালন করবে।” এই হেফাজতে ইসলামি আজ বুক ঠুকে বলছে, তাদের বাদ দিয়ে আর কোনও দলের সরকারে যাওয়া হবে না। ছ’টি পুরসভার মেয়র নির্বাচনে শাসক আওয়ামি লিগ গোহারা হওয়ার পরে অনেকে মনে করছেন, হেফাজতের সমর্থনে বলীয়ান বিএনপি-জামাত জোটই হয়তো এ বার সরকারে আসছে।
পিরোজপুরের সোহরাবর্দি কলেজের বাংলা অনার্সের ছাত্রী সনজিদা (২১) ও তাঁর ছাত্রী শ্রাবন্তী রায় (১৬) তখন একে অন্যকে ভালবেসে চলেছেন। সমাজের পুরুষতন্ত্র যে তাঁদের ভালবাসাকে মানবে না, বিলক্ষণই জানেন তাঁরা।
সমবেত জনতার উদ্দেশে মৌলানা শফি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, “কীসের জন্য তোমরা মেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাও, গারমেন্ট কারখানায় কাজে পাঠাও? জানো না তারা সেখানে কুকাজে লিপ্ত হয়?” শফি আবার বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের প্রধানও। কেন মেয়েদের প্রকাশ্যে বেরোনো নিষিদ্ধ হওয়া উচিত, সে বিষয়ে তাঁর অমোঘ যুক্তি, “মেয়েরা তেঁতুল। চোখের সামনে তাদের দেখলেই পুরুষের লালা ঝরে, সেটা কি পুরুষের দোষ? সমাজের ভালর জন্যই মেয়েদের দেওয়ালের আড়ালে থাকতে হবে।” |
শ্রাবন্তী ও সনজিদা। —নিজস্ব চিত্র |
শফি মৌলানার ফতোয়া লজ্জায় ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশের পুরুষদেরও। আর এমনই এক দিনে সনজিদা-শ্রাবন্তী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, পুরুষদের প্রয়োজনই নেই তাঁদের। একে অন্যকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না তাঁরা। ঢাকায় যাবেন, হিন্দু মতে বিয়ে করে মিশে যাবেন মহানগরের জনারণ্যে।
মৌলানার এই ফতোয়া সাম্প্রতিকতম, তবে তা অভিনব নয় একেবারেই। জামাতে ইসলামি-হেফাজতের কর্তাব্যক্তিরা হামেশাই এ সব কথা বলে থাকেন মেয়েদের উদ্দেশে।
শ্রাবন্তীর ডাকনাম পূজা। সনজিদা তাঁর বাড়িতে এসে পড়াতেন। পূজা হিন্দু, সনজিদা মুসলিম। ভালবাসা ধর্মের ভেদও মানেনি। দিন সাতেক আগে দু’জনে ঢাকায় চলে এসে ওঠেন মহম্মদপুরের মহম্মদিয়া আবাসনের ১৯৯ নম্বর ফ্ল্যাটে। পূজার বাবা কৃষ্ণকান্তি পুলিশে খবর দেন এই ভেবে যে কোনও বখাটে ছেলে তাঁর নাবালিকা কন্যাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। মোবাইল ফোনের টাওয়ার দেখে পুলিশ জানতে পারে মহম্মদপুরের আবাসনে রয়েছে পূজা। সোমবার রাতে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যুরোর একটি বাহিনী পূজাকে উদ্ধার করতে হানা দেয় আবাসনে। পূজা তখন নিজেই এগিয়ে এসে জানায়, “দু’টো মেয়ে একে অপরকে ভালবাসতে পারবে না? কেউ আমাদের তুলে আনেনি। হিন্দু মতে বিয়ে করে ঘর বেঁধেছি। তোমরা ফিরে যাও।”
র্যাবের অফিসার সাজ্জাদ জানান, “ওদের কথা শুনে আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ। বলেটা কী! দুটো মেয়ে ঘর বেঁধেছে বিলেত-আমেরিকায় হয়-টয়। তা বলে আমাদের বাংলাদেশে?” পূজা জানতে চান, “আমরা সুখে থাকলে র্যাব-পুলিশের কী অসুবিধে?”
সাজ্জাদ জানিয়েছেন পূজার প্রশ্নের জবাব তাঁরা দিতে পারেননি। কিন্তু আইনকানুন তো মানতে হয়। দুই মেয়ের এমন বেয়াড়া সম্পর্ক বাংলাদেশের আইনও তো মানে না। সুতরাং, দু’জনকে আটক করে বুধবার আদালতে তোলা হয়। বিচারক তাঁদের হাজতে পাঠিয়েছেন।
কিন্তু দুই মেয়ের এই স্পর্ধায় খান খান হয়ে গিয়েছে সমাজ-সংস্কার-ধর্মের চোখরাঙানি। হার মেনেছে মোল্লাদের ফতোয়াও। |