অনুব্রত মণ্ডলের ছায়া এ বার বীরভূম ছাড়িয়ে বর্ধমানেও।
বেশ কয়েক বছর ধরেই বর্ধমানের যে এলাকায় তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতির ‘দাপট’ রয়েছ, সেই মঙ্গলকোটের কয়েক জন নির্দল প্রার্থী (আসলে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) বুধবার তাঁদের আতঙ্কের কথা জানিয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। অনুব্রত-অনুগামীরাই যে এই আতঙ্কের কারণ, তা-ও লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে।
রায়না ১ ব্লকে তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে নির্দল হয়ে দাঁড়ানো ২৬ জন মঙ্গলবারেই পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন। রায়না ও মঙ্গলকোটের এই প্রার্থীদের প্রত্যেকেরই আশঙ্কা, আগামী ২৯ জুলাই ভোটগণনার দিনে তাঁদের গণনাকেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে না। সেখানে তাঁদের দেখা গেলে বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অনুব্রত অবশ্য আশ্বাস দেন, “কোথাও কোনও সমস্যা হবে না। সব ঠিক আছে।”
পঞ্চায়েত ভোটের মধ্যেই বীরভূমে এক সভায় অনুব্রত দলের কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, “কোনও নির্দল প্রার্থী হুমকি দিলে তার বাড়ি জ্বালিয়ে দিন। পুলিশ-প্রশাসন ওই নির্দলদের সমর্থন করলে তাদের বোমা মারুন।” তার পর থেকেই বিভিন্ন জায়গায় নির্দল হয়ে দাঁড়ানো বিক্ষুব্ধ তৃণমূল প্রার্থীদের উপরে শাসকদলের লোকজনের হামলা-হুমকি বেড়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। বীরভূমে তো বটেই, অন্য নানা এলাকাতেও।
সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে গত ২১ জুলাই, বীরভূমে ভোটের আগের রাতে। ওই জেলারই পাড়ুইয়ে কসবা গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্দল প্রার্থীর হৃদয় ঘোষের বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁর বাবা সাগর ঘোষকে গুলি করে আততায়ীরা। পরের দিন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। পুলিশ চার জনকে গ্রেফতার করলেও তারা আদৌ খুনে জড়িত নয় বলে পরিবারের দাবি। বরং মঙ্গলবার বিকেলেই পুলিশ সুপারকে রেজিস্ট্রি চিঠি পাঠিয়ে অনুব্রতের নামে নির্দিষ্ট অভিযোগ করেছেন হৃদয়বাবুর স্ত্রী শিবানী ঘোষ।
এত কিছুর পরেও অবশ্য পুলিশ বা শাসকদলের তরফে এখনও চোখে পড়ার মতো কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে আতঙ্কও কমেনি। এক সময়ে বর্ধমানের মঙ্গলকোট, কেতুগ্রাম ও আউশগ্রামে দলের সংগঠন অনুব্রতই দেখতেন। পরে কেতুগ্রামে দাঁড়িয়ে জেতেন বীরভূমের নানুরের নেতা শেখ সাহানেওয়াজ। পঞ্চায়েত ভোটের আগেই সাহানেওয়াজ ও তাঁর ভাই কাজল শেখের দাপটে নানুর-মঙ্গলকোটে অনুব্রত গোষ্ঠী কোণঠাসা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মঙ্গলকোট-সহ বহু এলাকাতেই দলের রাশ এখনও অনুব্রতর হাতেই।
এ দিন মঙ্গলকোটের ঝিলু ২ পঞ্চায়েতের নির্দল প্রার্থী স্বপ্না খাতুন, মানোয়ার গাজি, কাজি মনোয়ারুল হক-সহ বেশ কয়েক জন কাটোয়া মহকুমাশাসকের দফতরে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেন, অনুব্রত-অনুগামী নেতা তথা মঙ্গলকোট পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী শেখ আব্দুল বাসেদের নেতৃত্বে দৃষ্কৃতীরা তাঁদের হুমকি দিচ্ছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, এঁরা সকলেই মঙ্গলকোটের নেতা লিয়াকত শেখের অনুগামী। যদিও তৃণমূলের বর্ধমান (গ্রামীণ) সভাপতি তথা মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের সঙ্গে আগাম কথা বলেই তাঁরা ঝিলু-১ পঞ্চায়েতে ২টি, ঝিলু-২ পঞ্চায়েতে ৬টি, মঙ্গলকোট গ্রাম পঞ্চায়েতে ৫টি ও ভাল্যগ্রাম পঞ্চায়েতে ১টি আসনে তৃণমূলের হয়ে মনোনয়ন দাখিল করেছিলেন। কিন্তু অনুব্রত-গোষ্ঠীর লোক না হওয়ায় দলীয় প্রতীক পাননি। |
ভোটের আগে দলের নির্দেশে লিয়াকত শেখ নিজে প্রচারপত্র দিয়ে তৃণমূল প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার আবেদন জানালেও সমস্যা মেটেনি। নির্দল প্রার্থী মনোয়ার গাজির অভিযোগ, “গত পঞ্চায়েতে সিপিএমের হয়ে ভোটে জিতেছিলাম। লোকসভা নির্বাচনের পর মলয় ঘটকের উপস্থিতিতে আমরা ৮ জন পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলে যোগ দিই। কিন্তু অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামী না হওয়ায় পঞ্চায়েতের টিকিট পাইনি।” গত ১৫ জুলাই, বর্ধমানের ভোটের দিন অনুব্রত বীরভূম থেকে দুষ্কৃতী পাঠিয়ে গোলমাল পাকাবেন, এই আশঙ্কাতেও তাঁরা বিভিন্ন স্তরে চিঠি দিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও ভোটের দিন বোমা-গুলি চলে। তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষের সময়ে পূর্ব নওয়াপাড়া গ্রামে বোমায় এক জন মারাও যান।
অনুব্রত মণ্ডলের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও রায়না-১ ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির ২৬ জন নির্দল প্রার্থী লিখিত ভাবেই সেই এক আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন। এঁদের অন্যতম আয়েষা বেগম, শুভ্রা মল্লিক, রাণু বেগম মণ্ডলেরা দাবি করেন, তৃণমূলের কয়েক জন নেতার প্রতিশ্রুতিতেই মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় প্রতীক মেলেনি। এর পরে দল তাঁদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিতে বললেনও, তাঁর নির্দল প্রার্থী হিসেবে রয়ে যান। তারই মূল্য চোকাতে হচ্ছে।
রায়নার ওই প্রার্থীদের অভিযোগ, তৃণমূলের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাঁদের বাড়ির লোকেদের ভোট দিতে দেয়নি। এখন শেখ ইসমাইল ওরফে শান্ত ও সোমনাথ চন্দ ওরফে বাপ্পা নামের দু’জনের নেতৃত্বে ১৫-১৮ জনের একটি দুষ্কৃতী দল এলাকায় ঘুরে প্রচার চালাচ্ছে যে, ২৯ তারিখে তাঁদের গণনাকেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এই ব্যাপারে রায়না থানার ওসি রাকেশ সিংহের প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে বলেও তাঁরা অভিযোগ করেছেন। যদিও ওসি এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। বর্ধমান (দক্ষিণ) মহকুমাশাসক অরুণকুমার রায় বলেন, “কাউকে আলাদা করে নিরাপত্তা দেব কী করে? তবে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন থাকবে।”
মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের দাবি, “সিপিএম ও কংগ্রেস পিছন থেকে নির্দলদের সংগঠিত করছে। তাই তাঁরা এলাকায় আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা করছেন।” যা শুনে সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারের পাল্টা প্রশ্ন, “নির্দল তো সব ওদের। এর মধ্যে আমরা আসছি কোত্থেকে?” তবে শুধু নির্দলেরা নয়, গণনার দিন অশান্তির আশঙ্কা অমলবাবুরাও করছেন, যেমন করছে কংগ্রেস। প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অনুব্রত মণ্ডলের বক্তব্যের পর যা পরিস্থিতি হয়েছে, তাতে আমরাও আতঙ্কিত।” অনুব্রত অবশ্য এক কথায় সব উড়িয়ে বলেন, “ও সব অভিযোগ নিয়ে মাথাব্যাথা করার কারণ নেই।” |