ডেনড্রাইটের ছোট্ট টিউব। সেই আঠার গন্ধ বিশেষ পদ্ধতিতে নাকে টানলেই নেশায় বুঁদ হয়ে যান দেহ-মন। বাজারের হরেক কিসিমের নেশা সামগ্রীর মতো ওই আঠা যে প্রাপ্তবয়ষ্কদের ছাপিয়ে স্কুল পড়ুয়াদেরও আসক্ত করছে, গড় রাইপুর হাইস্কুলের হস্টেলের ছাত্র রানা কালিন্দীর মৃত্যুর ঘটনা তা প্রকাশ্যে এনে দিল। তবে হস্টেলে থেকে কী ভাবে কমবয়েসী ছেলেরা এই নেশা করতে পারছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের দাবি, স্কুল কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব এতে প্রকট হয়েছে। রাইপুরের বিডিও কিংশুক মাইতি বলেন, “রাইপুরের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শককে হস্টেলে গিয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে।” |
গড় রাইপুর হাইস্কুলের পাশেই রয়েছে ছাত্রদের হস্টেল। সেখানে ২৭টি ঘরে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ২৭০ জন ছাত্র থাকে। প্রতিটি ঘরের মেঝেয় শতরঞ্জি পেতে ৮ থেকে ১২ জন করে থাকে। হস্টেলের একটি ঘরে থাকত রানা কালিন্দী। তার ভাই রাজা কালিন্দীও এই হস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করে। আবাসিকেরা জানায়, রবিবার সকালে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া রানার সঙ্গে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুই ছাত্র বাইরে যায়। রানা ও ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রটি খানিক পরে ফিরে এসে হস্টেলের একটি ঘরের মেঝেতে অর্ধচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকে। তাদের বাঁকুড়া মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পথেই মৃত্যু হয় রানার। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রটিকে বাঁকুড়া মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রটি নেশা করে বাড়ি চলে গিয়েছিল। বিকেলে তাকেও গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ওই হাসপাতালে ভর্তি করেন বাড়ির লোকেরা।
সোমবার গড় রাইপুর হাইস্কুলে গিয়ে দেখা যায়, শোকাচ্ছন্ন গোটা স্কুল চত্বর। প্রার্থনার পরে রানা কালিন্দীর স্মরণে শিক্ষক ও পড়ুয়ারা নীরবতা পালন করে। এরপরেই স্কুলে ছুটি দেওয়া হয়। হস্টেল অবশ্য খোলা ছিল। কিন্তু ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরেও দেখা গিয়েছে, আবাসিকদের বিহ্বলতা কাটেনি। অনেকেই ঘরের মধ্যে জড়োসড়ে হয়ে ছিল। হস্টেলের চেনা হইচই দেখা যায়নি। রানার ‘রুমমেট’ ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র হিমালয় সোরেন আমতা আমতা করে শুধু বলল, “ওইসব জিনিস আমি কোনওদিন করিনি। ওরা এ সব করায় আমার ভীষণ ভয় লাগছে। হস্টেলে থাকতে ভয় পাচ্ছি।” অষ্টম শ্রেণির এক আবাসিক ছাত্র অবশ্য বলেছে, ‘‘কিছুদিন ধরেই হস্টেলের কয়েকজন ডেনড্রাইটের আঠা কিনে এনে গোপনে নেশা করছিল। বারণ করলে পাছে ওরা মারধর করে, তাই আমরা কিছু বলতে পারিনি।’’
গড় রাইপুর হাইস্কুলের হস্টেল থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, রাস্তার দু’ধারে কয়েকটি মুদিখানা, স্টেশনারি ও চায়ের দোকান রয়েছে। হস্টেলের আবাসিকেরা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস ওইসব দোকান থেকেই কেনাকাটা করে। মুদিখানা ও স্টেশনারি দোকানগুলিতে দেখা গেল অন্য আঠার সঙ্গে ডেনড্রাইটও রয়েছে। গড় রাইপুর হাইস্কুলের এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘কর্মক্ষেত্রের খাতা ও হাতের কাজের সামগ্রী তৈরির সময় ডেনড্রাইটের দরকার হয়। সেই আঠাই এখন নেশার বস্তু হিসাবে ব্যবহার করছে কিছু কম বয়েসী ছেলে।’’ তবে রাইপুর বাজারের এক দোকানদারের সাফাই, “আমরা তো নিষিদ্ধ কিছু বিক্রি করছি না। পড়াশোনার কাজের জন্য ছাত্রেরা ডেনড্রাইট-সহ অন্য আঠাও কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তা কে কী কাজে লাগাচ্ছে, জানব কী করে?”
দক্ষিণ বাঁকুড়ার অন্যতম নামকরা এই স্কুলের হস্টেলে ছেলেদের রেখে যে অভিভাবকেরা এতদিন নিশ্চিন্তে থাকতেন, আতঙ্ক ছড়িয়ে তাঁদের মধ্যেও। অভিভাবক রাইপুরের রাজগাঁ গ্রামের বাসিন্দা বৈদ্যনাথ হেমব্রম, রঘুনাথপুর গ্রামের বাজুন মাণ্ডিরদের বক্তব্য, “খুব কষ্ট করে ছেলেদের হস্টেলে রেখে পড়াশোনা করাচ্ছি। হাত খরচের সামান্য টাকাটুকু যদি কেউ নেশা করে নষ্ট করে, তা হলে আমরা অসহায়।” তাঁদের দাবি, অবিলম্বে হস্টেলে দিনরাত্রি নজরদারি চালু করতে হবে। সেই সঙ্গে আর কেউ নেশায় আসক্ত থাকলে, তাকে চিহ্নিত করে ছাত্রাবাস থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। রাইপুরের বিডিও কিংশুক মাইতিও বলেন, “অন্য কোনও আবাসিক নেশা করে থাকলে তাকে বের করে দিতে নির্দেশ দেব।”
হস্টেলে স্থায়ী ভাবে সুপার নেই। স্কুলেরই শিক্ষক যামিনীকান্ত টুড সেই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। তিনি বলেন, “আমাদের নজর এড়িয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে কেউ ডেনড্রাইট নিয়ে নেশা করছে বলে এই প্রথম জানা গেল। প্রত্যেকের উপর আরও নজর বাড়ানো হচ্ছে।” স্কুলের প্রধানশিক্ষক রাজকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “হস্টেলে আরও কয়েকজন এই নেশা করে বলে জানতে পেরেছি। তবে ছেলেরা কেউ মুখ খুলছে না। ছাত্রদের এই রকম উদ্ভট নেশা না করার জন্য বলেছি। খুব শীঘ্রই বৈঠক ডেকে অভিভাবকদের মতামত নিয়েই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, “স্কুলটির আশেপাশে পুলিশকে নজর রাখতে বলা হয়েছে। পুলিশ ছাত্র ও অভিভাবকদের নিয়ে এলাকায় সচেতনতা শিবিরও করবে।”
২০০৮ সালে এই গড় রাইপুর হাইস্কুলের ছাত্র কুমুদ বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম হয়েছিলেন। তাঁর স্কুলের এই ঘটনায় কার্যত স্তম্ভিত কুমুদ চেন্নাই থেকে ফোনে বলেন, “এমন ঘটনা শুনতেও খারাপ লাগছে। আমি মর্মাহত। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা আমার গর্বের স্কুলে না ঘটে তার জন্য সকলকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।” কুমুদের কথা কী শুনতে পাচ্ছে ছাত্রেরা? |