বর্ধমানের গ্রামে গঞ্জে অতি পরিচিত এক সাপ ঝঙ্কেশ্বরী। গাঁয়ের লোক আদর করে তাকে ঝাঙ্গলাই বলে ডাকে। বর্ধমানের ভাতার, মঙ্গলকোট সীমান্তের সাতটি গ্রাম, বড় পোষলা, ছোট পোষলা, শিকরতোড়, মইদান, পলসনা, নিগন, মসুরিতে দেখা যেত এই সাপ। কিন্তু এঁটুলি আর টিকসের আক্রমণে এই সাপ এখন লুপ্তপ্রায় প্রজাতি। সম্প্রতি সংরক্ষণশালা করে এই প্রজাতির সাপের সংরক্ষণের দাবি তুলেছেন দুই সর্প বিশারদ।
প্রতি বছর মঙ্গলকোটের ছোট পোষলা, পলসান ও মসারু এবং ভাতারের বড় পোষলা গ্রামে আষাঢ় নবমীতে পুজো করা হয় ঝঙ্কেশ্বরী সাপের। গ্রামগুলিতে মন্দিরও রয়েছে ঝঙ্কেশ্বরীর। তিথি অনুযায়ী, আজ, মঙ্গলবারই সেই আষাঢ় নবমী। পুজো হবে সর্পদেবীর। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, লুপ্ত হতে হতে এই গ্রামগুলিতেও এখন ঝাঙ্গলাইয়ের দেখা পাওয়া ভার। একমাত্র ভাতারের বড় পোষলা গ্রামেই টিঁকে রয়েছে তিনশো বছরের পুরনো এই প্রজাতির সাপ। আর মঙ্গলকোটের ছোট পোষলা, পলসান আর মসারুতে খুব কম হলে দেখা মিলতে পারে ঝাঙ্গলাইয়ের। |
সাপ পুজো নিয়ে তাই আজ বড় পোষলা গ্রামে মহোৎসব। প্রায় দুর্গাপুজোর মতোই মর্যাদা পায় এই পুজো। বড় মেলা বসে গ্রামে। গ্রামের ঝঙ্কেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, “দুর্গাপুজোর সময়ে যেমন ঘরে ফেরেন বাইরে চাকরি করা গ্রামের ছেলেমেয়েরা, তেমনই আষাঢ় নবমীতেও আসেন সকলে।”
বিলুপ্তপ্রায় সাপেদের নিয়ে প্রায় এক যুগের উপর কাজ করছেন ভাতারের যুবক ধীমান ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “এই সাপ জাতে কেউটের সমগোত্রীয়। কিন্তু কিছু পার্থক্য রয়েছে। এদের ফনা রয়েছে। তাতে আবার গোখরোর মত ছাপ। ওদের বাসার সঙ্গে শঙ্খচূড়ের বাসার মিল রয়েছে। অন্যান্য সাপের মতো এরা নিশাচর নয়। বরং দিনেই এদের বেশি দেখা যায়। অন্যান্য সাপের মতো এরা দ্রুতগতিতে এসে আচমকা কামড়ায়ও না। এটি যেন প্রকৃতির এক বিস্ময়। কিন্তু ছ’বছর ধরেই এই সাপের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। এমন কী বড় পোষলা গ্রামেও এদের সংখ্যা এত কমেছে, যা চোখে পড়ার মতো।”
শ্যামলবাবুও জানান, এই সাপ প্রায় নির্বিবাদীই বলা চলে। যদিও এই সাপেরও বিষ রয়েছে। মাঝে মধ্যে দু’এক কামড় যে দেয় না, তা নয়। কিন্তু তা ধরার মতো নয়। তিনি বলেন, “আমরা যেমন সাপকে পূজো করি তেমনি সাপও আমাদের কোনও ক্ষতি করে না। মানুষকে সাপে কামড়ালেও, সেই কামড়ে কেউ মারা গিয়েছেন, এমন ঘটনা নেই।” গ্রামের গৃহবধূ মুনমুন দে’ও বলেন, “আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির উঠোনে, উনুনের ভিতর বা আলনা বিছানাতেও নির্বিবাদে ঘুরে বেড়ায় সাপেরা। তবে মাঝে মাঝে কামড়েও দেয়। তাতে সামান্য জ্বালা করে। কয়েক দিন পরই ঘা শুকিয়ে যায়।” |
মৃত সাপ এই ভাবেই হাঁড়িতে ভরে বাঁশ গাছে রেখে দেন বাসিন্দারা। |
কিন্তু কেন এই ভাবে কমছে সাপের সংখ্যা? ধীমানবাবু বলেন, “গ্রামগুলিতে মানুষের কাছে সাপেরা এতই পবিত্র যে মৃত সাপ ভাগীরথীতে বিসর্জন দেওয়াটাই রীতি। কিন্তু একটা দু’টো সাপ মারা গেলে গ্রামের মানুষ সেগুলি গ্রামের বাঁশতলায় হাঁড়ির ভিতর ভরে রাখছেন। সেখান থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে এঁটুলি। সুস্থ সাপের শরীরে বাসা বাঁধছে। তার ফলে সাপের দেহেও প্রোটোজোয়ার সংক্রমণ হয়ে তাদের রক্তের কোষ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।” সাপের সংখ্যা কমার কারণ বুঝতে ওই গ্রামে এসেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাপ গবেষক হিমাদ্রী ঘোষ। তিনি বলেন, “সাপ আর মানুষের এমন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখে আমি অবাক। কিন্তু সাপের শরীরে এঁটুলির বাসা। বিজ্ঞানের ভাষায় এঁটুলি হল স্কেল ইনসেক্টস। তারাই সাপের সব রক্ত শুষে নিচ্ছে। ফলে অ্যানিমিক হয়ে মরে যাচ্ছে সাপ।”
সাপ বাঁচাতে গ্রামের মধ্যেই একটি সংরক্ষণশালা খোলার দাবি করেছেন ওই দুই পর্যবেক্ষক। তাঁদের বক্তব্য, এমন ‘শান্ত সাপে’র কথা অন্যান্য জায়গার মানুষ সে ভাবে জানেন না। সংরক্ষণশালা হলে নানা জায়গা থেকে প্রকৃতি-প্রেমী মানুষ ও বিজ্ঞানীরাও ছুটে আসবেন এই বড়পোষলায়।
|