|
|
|
|
শান্তির আবেদনে যুক্তি মমতার |
এক দিনের ভোটে এত হিংসা হতো না
নিজস্ব প্রতিবেদন |
পঞ্চায়েত ভোটে চতুর্থ দফার প্রাক্কালে হিংসা, রক্তপাত ও প্রাণহানির ঘটনা যখন বেড়েই চলেছে, তখন শান্তির আবেদন জানালেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হিংসা বন্ধের জন্য বিরোধীদের আর্জি জানানোর পাশাপাশি দলীয় কর্মীদের প্রতিও তৃণমূল নেত্রীর পরামর্শ, তাঁরা যেন মাথা ঠান্ডা রাখেন এবং প্ররোচনায় পা না দেন। একই সঙ্গে নিজের এক দিনে গোটা রাজ্যে ভোটের তত্ত্বকে মনে করিয়ে দিয়ে তাঁর বক্তব্য, তা হলে এত রক্তপাত হতো না।
প্রথমে মনোনয়ন-পর্ব এবং তার পরে পঞ্চায়েত ভোট চলাকালীন অতীতের মতোই এ বারও উত্তপ্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। ভোটের মধ্যেই এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১১ জনের। এই পরিপ্রেক্ষিতেই রবিবার মমতার আর্জি, “আমরা পশ্চিমবঙ্গকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে দায়বদ্ধ। তৃণমূল সন্ত্রাস চায় না। সবাইকে বলছি, শান্তি রাখুন। মানুষকে ভোট দিতে দিন। কেউ খবরদারি করবেন না!” মানুষের প্রতি তাঁর আরও বার্তা, “পঞ্চায়েত ভোট আজ বাদে কাল মিটে যাবে। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনাদের শান্তিপূর্ণ ভাবে রাজ্যে থাকতে হবে।”
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রথম দুই দফায় অশান্তি হয়নি (দ্বিতীয় দফার ভোটে অবশ্য তিন জন মারা যান)। তৃতীয় দফা থেকেই সমস্যা শুরু হয়েছে এবং মুখ্যমন্ত্রী সে জন্য দায়ী করেছেন সিপিএম-কংগ্রেস-সহ সব বিরোধী ও কোথাও কোথাও মাওবাদীদেরও। বীরভূম, মুর্শিদাবাদ-সহ চার জেলায় আজ, সোমবার চতুর্থ দফায় ভোট। মুর্শিদাবাদে প্রতি পঞ্চায়েত ভোটেই অশান্তির ঘটনা ঘটে। তার ঠিক আগে মুখ্যমন্ত্রীর শান্তির আবেদনকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় স্তরের ভোট আরও আগে এবং এক দফায় সেরে ফেললে অশান্তি বেশি দূর গড়াত না। তিনি বলেন, “আমি প্রথম থেকেই পঞ্চায়েত নির্বাচন তাড়াতাড়ি করতে চেয়েছিলাম। আমি তো বলেছিলাম জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ভোট করতে।” তাঁর যুক্তি, তখন আবহাওয়া ভাল থাকে। তখন ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল সিপিএম। মমতা বলেছেন, “এর পর রমজান, ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা কোনও যুক্তির তোয়াক্কা না করে পাঁচ কিস্তিতে ভোটের সিদ্ধান্ত হয়। এখন যে জেলায় যে ভাবে নির্বাচন কমিশন আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েন করার সুপারিশ করেছে, সেই ভাবেই তা মোতায়েন করছে রাজ্য সরকার।” তিনি মনে করিয়ে দেন, অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, পঞ্চায়েত নির্বাচনে রক্তস্নান হবে। কিন্তু রাজ্য সরকার সর্বশক্তি দিয়ে তা আটকেছে। একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “যে ক’টি প্রাণহানি হয়েছে, তা-ও হওয়া উচিত ছিল না।”
তৃণমূলের ওয়েবসাইটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও এক বা দু’দিনে ভোট করানোর ব্যাপারে যুক্তি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, পঞ্চায়েতে অনেক সময় একই পরিবারের একাধিক সদস্য বিভিন্ন দলের হয়ে ভোটে দাঁড়ান। ব্যক্তিগত পর্যায়ের রেষারেষি সেখানে প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক আদর্শ পরিণত হয় সংঘাতে। এই অনভিপ্রেত পরিস্থিতি এড়াতে এক দিনে ভোট সেরে ফেলা যেত। রাজ্য পুলিশ দিয়ে রাজ্য সরকার সাহায্য করত। কিন্তু সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি, এমনকী, আদালতও তাঁদের যুক্তি মানেনি। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “এটা লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচন নয়। আমার কথা শুনে এক বা দু’দিনে ভোট হয়ে গেলে একটাও খুন হতো না! জোর করে পাঁচ দিনে ভোট করা হচ্ছে। এক মাস ধরে কখনও পঞ্চায়েত ভোট হয়?” |
২১ জুলাই উপলক্ষে শহিদদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। ধর্মতলায়।—নিজস্ব চিত্র |
এক দিনে ভোট চেয়ে গোড়া থেকে সওয়াল করছিল রাজ্য। পরে অবশ্য দফা বাড়াতে রাজি হয় তারা। হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলে। শেষ পর্যন্ত পাঁচ দফায় ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করে শীর্ষ আদালত। মুখ্যমন্ত্রী ফের সেই প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসার প্রেক্ষিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে বলেছেন, “নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তাই আমি কোনও দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করতে পারি না।” কমিশনের সচিব তাপস রায়ের
ব্যাখ্যা, “দফা আমরা বাড়াইনি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই দফা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া এ বিষয়ে আমাদের আর কিছু বলার নেই।”
কমিশন সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, ভোটের আগে বিভিন্ন পর্যায়ে জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারদের সঙ্গে বৈঠক করেই কমিশনের আশঙ্কা হয়েছিল, এ বারের ভোটে তুলনামূলক ভাবে হিংসার ঘটনা বাড়তে পারে। তাই প্রথম থেকেই তারা একাধিক দফায় নির্বাচনের সুপারিশ করেছিল। কলকাতা হাইকোর্টে পঞ্চায়েত মামলায় এই যুক্তি নিয়েই সওয়াল করেছিল কমিশন। তথ্য বলছে, অতীতে এক দিনে যখন পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে, হিংসার বলি হয়েছে বিপুল। যেমন, ২০০৩ (সে উদাহরণ মুখ্যমন্ত্রী নিজেও দিয়েছেন)। আবার একাধিক দিনে ভোট করেও হিংসা ও প্রাণহানি আটকানো যায়নি। যেমন, ২০০৮। এর কোনও ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট হয়নি। তাই এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিল কমিশন।
এই ইতিহাস মাথায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রীর এক দিনের যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা।
মুখ্যমন্ত্রীর শান্তির আবেদনকে অবশ্য স্বাগত জানিয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “এক দিন না পাঁচ দিন, অনেক বিতর্কের পরে এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, বিলম্বে হলেও তার মধ্যে কাজের কথা শান্তির আবেদনটাই। উনি ঠিকই বলেছেন, ভোটের পরে দলমত নির্বিশেষে সকলকে একসঙ্গে থাকতে হবে। এটা আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি।” তবে মুখ্যমন্ত্রী যদি শান্তির আর্জিতে আন্তরিক হন, তা হলে তাঁর সর্বদল বৈঠক ডেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা উচিত বলে সূর্যবাবু মনে করেন। বিরোধী দলনেতার প্রস্তাব, “কমিশন সর্বদল বৈঠক ডাকলে ওঁরা তো যাননি। তা হলে নিজের প্রশাসনকে দিয়েই বৈঠক ডাকুন।”
আর এক বিরোধী দল কংগ্রেসের অভিমত, মুখ্যমন্ত্রীর কথা এবং বাস্তবের মধ্যে মিল নেই। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার যুক্তি, এ বার মনোনয়ন-পর্বেই ১২ জন খুন হয়েছেন। অতীতে কোনও পঞ্চায়েত নির্বাচনে যা হয়নি। তা হলে রাজ্যের হাতে যা নিরাপত্তা বাহিনী আছে, তা-ই দিয়ে মোট ৫৭ হাজারেরও বেশি বুথে এক দিনে ভোট করতে গেলে কী অবস্থা হত, প্রশ্ন তুলেছেন তিনি! মানসবাবুর কথায়, “৩৪ বছরের জমানায় সর্বাধিক ৬ হাজার ৮৫০ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল সিপিএম। আর দু’বছরের বিশেষ প্রশিক্ষণে বর্তমান শাসক দল ৬ হাজার ৬২৫ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে প্রায় ৭৫ লক্ষ ভোটারকে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে! সিপিএমের পথ অনুসরণ করে যাঁরা গণতন্ত্রকে হত্যা করছেন, তাঁরা আর কাকে শান্তির কথা বলছেন?”
প্রশ্ন উঠেছে, তিন দফার ভোট পেরিয়ে যাওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী শান্তির আবেদন করছেন কেন? দলীয় ওয়েবসাইটে মুখ্যমন্ত্রী ব্যাখ্যা দিয়েছেন, প্রথম তিন দফায় যে সব জেলায় ভোট হয়েছে, সেখানে তৃণমূলের জনসমর্থন অনেক বেশি। পরের দফাগুলিতে মালদহ, মুর্শিদাবাদের মতো জায়গায় কংগ্রেসের অস্তিত্ব রয়েছে এবং তারা সেখানে দুষ্কর্মের আশ্রয় নিয়েছে। আবার সিপিএম এবং কোথাও মাওবাদীরা পরিস্থিতি ঘোরালো করার চেষ্টা করছে। মমতার মন্তব্য, “যে সব জায়গায় ভোটের সময় বিক্ষিপ্ত ঘটনা হয়েছে, সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত বা জেলা পরিষদ স্তরে ক্ষমতাসীন দল সিপিএম। সিপিএম যেখানে ক্ষমতায় রয়েছে, সেখানে তারা এখনও সন্ত্রাস করছে।” বিরোধী নেতা-নেত্রীদের উস্কানিমূলক বক্তৃতাও বন্ধ করতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রীর এমন ব্যাখ্যা বিরোধীরা মানতে নারাজ। সূর্যবাবুর কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী একটা ইতিবাচক কথা বললে সঙ্গে দশটা নেতিবাচক বলেন! নেতিবাচকে তখন ইতিবাচকটা চাপা পড়ে যায়!” বিরোধী দলনেতার প্রশ্ন, অনুব্রত মণ্ডল, তাপস পালেরা প্রকাশ্যে যে ধরনের মন্তব্য করে ছাড় পেয়ে গিয়েছেন, সেই দলের নেত্রী উস্কানিমূলক কথাবার্তার জন্য অন্যের দিকে আঙুল তোলেন কী ভাবে? একই ভাবে কংগ্রেসের মানসবাবু বলেছেন, “তৃণমূলের এক জেলা সভাপতি
ঘর জ্বালিয়ে দিতে বলছেন। ওঁদেরই এক বিধায়ক আমাদের বীরভূমের নেতা সব্যসাচী দত্তের মুণ্ডু নামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন! তা হলে কংগ্রেস উস্কানিটা দিল কোথায়?” কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি মালদহের কালিয়াচকেও তৃণমূলের সন্ত্রাসের জন্য কংগ্রেস প্রার্থী দিতে পারেনি বলে মানসবাবুর অভিযোগ।
এই প্রেক্ষাপটে মুখ্যমন্ত্রীর শান্তির আর্জিতে কতটা কাজ হল, উত্তর মিলবে আজ থেকেই! |
|
|
|
|
|