বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ভেবেছিলেন রাষ্ট্রপতি ভবনের সমস্ত পর্দা বদলে খাদির পর্দা লাগাবেন। সদ্য সৃষ্ট খাদি গ্রামোদ্যোগের কিছু কর্মী বিশাল এই প্রাসাদে বসেই সেই নতুন পর্দা তৈরি করবেন। রাজেন্দ্রপ্রসাদের উদ্দেশ্য ছিল, নতুন পর্দার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ভবনে পাশ্চাত্য প্রভাব বদলে স্বদেশী হাওয়া আনবেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অবশ্য সে প্রস্তাব খারিজ করে দেন। মন্ত্রিসভা জানায়, পুরো রাষ্ট্রপতি ভবনে খাদি-বিপ্লব করতে গেলে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে, যা সে সময়ে অগ্রাধিকার হতেই পারে না। বলা হয়েছিল, ব্রিটিশদের পর্দাগুলো কী অপরাধ করেছে? সুদৃশ্য দামি সে সব পর্দা না সরানোই ভাল।
এর পর একাধিক রাজনৈতিক বিষয়েও তাঁর সঙ্গে মতপার্থক্য বেড়েছিল নেহরুর। রাজেন্দ্রপ্রসাদের সামরিক সচিব ছিলেন এক বঙ্গ সন্তান, বিমানেশ চট্টোপাধ্যায়। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, নেহরু মন্ত্রিসভার আশঙ্কা ছিল, ব্রিটিশদের পর্দা বদলে খাদির কাপড় লাগানো হলে বাবুজিকে সামনে রেখে বিহারের কিছু স্থানীয় নেতা দুর্নীতির পথ নেবেন।
এর পর রাইসিনা হিল অনেক রাষ্ট্রপতি দেখেছে। রাজেন্দ্রপ্রসাদের পরেই রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, যিনি এই বিশাল প্রাসাদে বসেই দর্শন চর্চা করেছেন। রাধাকৃষ্ণন রাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা কর্ণ সিংহ বলেছেন, রাধাকৃষ্ণন যেন আমাদের ‘দার্শনিক রাজা’ ছিলেন। এ হেন রাধাকৃষ্ণনের সঙ্গেও নেহরুর মতপার্থক্য হয়েছিল চিনা আক্রমণের সময়। হিন্দু কোড বিল নিয়েও নেহরুর সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য হয়েছিল। আবার আশির দশকে জৈল সিংহের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, তিনি রাষ্ট্রপতি ভবন থেকেই রাজীব গাঁধীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কে আর নারায়ণনের মতো রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে খোদ মুলায়ম সিংহ যাদব এক বার অভিযোগ তুলেছিলেন
যে, তিনি সনিয়া গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় বসাতে সক্রিয়। |
মগ্ন পাঠক। রাষ্ট্রপতি ভবনের গ্রন্থাগারে। |
আগামী ২৫ জুলাই ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেমন রাষ্ট্রপতি প্রণববাবু? রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্র বলছে, প্রণববাবু জৈল সিংহ হবেন না কোনও দিন, আবার নারায়ণন বা শঙ্করদয়াল শর্মাও হবেন না। তিনি ‘টেক্সট বুক’ রাষ্ট্রপতি হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। রাষ্ট্রপতির সচিব ওমিতা পালের কথায়, “সংবিধানকে রক্ষা করাটাই রাষ্ট্রপতির প্রধান কর্তব্য। সেই দায়িত্ব পালনেই তাঁর রুচি।” তবে সংবিধানের চেনা ছকে হেঁটেও অন্যদের তুলনায় অনেকটাই আলাদা প্রণববাবু।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে প্রণববাবু সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও চুপ করে বসে থাকার মানুষ তিনি নন। প্রতিভা পাটিলের মতো বিদেশ ভ্রমণের শখ নেই তাঁর। তা ছাড়া গোটা পৃথিবীটা তাঁর এমনিতেই ঘোরা। এই অবস্থায় বসে না থেকে গত এক বছরে দেশের ২৩টি রাজ্যে সফর করে ফেলেছেন তিনি। আর সে সবের ফাঁকে ফাঁকেই রাষ্ট্রপতি ভবনের ভিতরে তাঁর নির্দেশে চলছে ব্যাপক সংস্কার প্রক্রিয়া। প্রায় ৪০০ ঘরের মধ্যে বহু ঘর এ যাবৎ তালাবন্ধ হয়ে ছিল। সে সব ঘর এখন একে একে খোলা হচ্ছে। বহু ঘরে তোরঙ্গ বন্দি হয়ে থাকা শত শত পর্দা, কার্পেট। সে সব নতুন করে লাগানো হচ্ছে। ডিসেম্বর মাসের মধ্যে রাষ্ট্রপতি ভবনকে মিউজিয়াম হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা যাবে, এমনটাই আশা রাষ্ট্রপতির। যে ভাবে ক্রেমলিনের রাজপ্রাসাদ বা বাকিংহাম প্যালেসের একটি বড় অংশ সাধারণ মানুষ দেখতে যেতে পারেন, সে ভাবেই এ বার রাষ্ট্রপতি ভবনকেও পর্যটকদের দ্রষ্টব্য স্থল হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। ঢেলে সাজা হচ্ছে গ্রন্থাগারটিও। সেটিকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসাই লক্ষ্য।
সব মিলিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে এক বিপুল পরিবর্তন আনছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু সে পরিবর্তন শুধুই বহিরঙ্গে নয়। প্রশাসনিক মহলের পর্যবেক্ষণ, সাংবিধানিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে সংবিধানের চৌহদ্দির মধ্যে থেকেও এক অন্য রকম স্বকীয়তা বজায় রাখছেন প্রণববাবু, যা তাঁর আগের বেশ ক’জন পূর্বসূরির ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। সুভাষ কাশ্যপ, ফলি নরিম্যানের মতো সংবিধান বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ব্রিটেনের রানির মতোই। তাঁর কোনও নিজস্ব মতামত থাকতে পারে না। |
রাষ্ট্রপতি ভবনের মোগল গার্ডেনে। |
তবে সংবিধানে সাদা-কালোর মধ্যে বিস্তৃত এক ধূসর এলাকা আছে। সাংবিধানিক চৌহদ্দির মধ্যে থেকেও রাষ্ট্রপতির ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালনের যথেষ্ট সুযোগ আছে। রাষ্ট্রপতি সরাসরি রাজ্যপালকে প্রশাসন চালনার ক্ষেত্রে মতামত দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর কাছ থেকে মতামত নিতে পারেন। দেশের নানা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ‘ভিজিটর’ বা পর্যবেক্ষক। চাইলেই তিনি উপাচার্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। দেশের সেনাপ্রধানদের কাছ থেকেও সরাসরি মতামত জানতে এবং চাইতে পারেন।
গত এক বছরে সংবিধানের গণ্ডীর মধ্যে থেকেও ভারসাম্য বজায় রেখে এই ব্যতিক্রমী ভূমিকাটিই প্রণব মুখোপাধ্যায় সুচারু ভাবে পালন করেছেন বলে মনে করছেন সরকার এবং বিরোধী পক্ষের বহু নেতাই। মন্ত্রিসভায় থাকার সময়ে প্রণববাবুর সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, তিনি কিছুটা কট্টরবাদী এবং জাতীয়তাবাদী। ইউপিএ-র প্রথম দফার শেষ লগ্নে প্রতিভা পাটিল একাধিক মৃত্যুদণ্ডের সাজা মকুব করেছিলেন। কিন্তু প্রণববাবু এসেই একাধিক মৃত্যুদণ্ডের আদেশে সই করেছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ঘটনা হল, প্রণববাবু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে এ প্রসঙ্গে একটা কথা জানিয়েছিলেন। তা হল, সরকার আগে সিদ্ধান্ত নিক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে কি না। তার পর সেই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাক। সরকার যেন এমন প্রত্যাশা না করে যে, মৃত্যুদণ্ড নিয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে এবং সেটা তিনি দিনের পর দিন ফেলে রাখবেন। এই ‘সাপও মরবে এবং লাঠিও ভাঙবে না’-র সরকারি কৌশল নিয়ে আপত্তি রয়েছে প্রণববাবুর।
মন্ত্রিসভার কোনও সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের কাছে ফেরৎ পাঠানোর বিষয়টিতেও আপত্তি রয়েছে প্রণববাবুর। কারণ? রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রণববাবু নিজের সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা জানেন। তিনি একবার ফেরৎ পাঠাতে পারেন। কিন্তু সংবিধান অনুসারে সরকার যদি সেটি আবার রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেয়, তা হলে তখন তিনি তাতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য। প্রণববাবু মনে করেন, পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হলে তিনি বরং ঘরোয়া ভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আগাম কথা বলে নেবেন। শুধু শুধু ফেরৎ পাঠিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে ‘ব্যক্তি প্রণবের’ অভিমত প্রতিষ্ঠার জনপ্রিয় রাজনীতি করে লাভ কী? তিনি এ ব্যাপারে আব্দুল কালামের মতো ব্যক্তি পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করতেও উৎসাহী নন। ‘ব্যক্তি প্রণবের’ কোনও মতামত থাকতে পারে বলে তিনি মনেই করেন না।
বিতর্কিত হতে চান না বলেই দিল্লির ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে বিদ্রোহী জনতা যখন রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে ধর্না দিয়েছিল, তখন তিনি দেখা করতে রাজি হননি। দিল্লি সরকারের সঙ্গে তখন ধর্ষণ নিয়ে নাগরিক সমাজের সংঘাত চলছে। তিনি সচিবকে নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের জানান, দেশে সরকার রয়েছে। তারা সরকারের কাছে যাক। একই ভাবে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তাতেও তিনি অংশ নেননি। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভিজিটর’। কিন্তু উপাচার্য চাইলেও তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হননি।
শঙ্করদয়াল শর্মা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিজেপিকে সরকার গড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপির প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন এবং ১৩ দিনের সরকারের পতন হয়। এর পর নারায়ণন এই সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য জোট সরকারের ক্ষেত্রে একটি নতুন শর্ত আরোপ করেন। সেটি হল, একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নয়, জোট হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে আগে লিখিত তালিকা দিয়ে সরকার গড়ার দাবি জানাতে হবে। সেই তালিকার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণও দিতে হবে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতির ভূমিকা কী হবে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট জল্পনা রয়েছে দিল্লির অলিন্দে। রাষ্ট্রপতি ভবনের অবশ্য স্পষ্ট বক্তব্য, যে রীতি নারায়ণন তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন, প্রণববাবু সেটা ভেঙে নাটকীয় কিছু করার পক্ষপাতী নন।
শুধু কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে নয়, নরেন্দ্র মোদী থেকে মুলায়ম সিংহ যাদব এমনকী প্রকাশ কারাটের সঙ্গেও সম্প্রতি বৈঠক করেছেন প্রণববাবু। নিয়মিত মধ্যাহ্ন ভোজনে আমন্ত্রণ করছেন নানা দলের নানা নেতাকে। আবার সনিয়া বা রাহুল গাঁধীর সঙ্গেও নিয়মিত মধ্যাহ্নভোজ বা নৈশভোজ করছেন। আগে অনিয়মিত থাকলেও এখন রাজ্যপালদের সঙ্গে বার্ষিক সম্মেলনের দিনক্ষণও ঠিক করে দিয়েছেন। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে ঐকমত্যের প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। গত এক বছর সেই ঐকমত্যের রাজনীতিকেই আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। দেশের প্রায় সব দলের শীর্ষ নেতাই প্রণববাবুকে তাঁদের ‘নিজস্ব উপদেষ্টা’ বলে মনে করেন! |