দোতলায় একা থাকা বাড়িওয়ালাকে রোজকার মতো রেঁধে খাবার পাঠিয়েছিলেন একতলার ভাড়াটে, অশীতিপর শান্তা মুখোপাধ্যায়। সে দিন রেঁধেছিলেন মাংস। যা খাওয়ার সময়ে মাংসের হাড় কোনও ভাবে গলায় আটকে মারা যান ষাটোর্ধ্ব বাড়িওয়ালা গৌতমরঞ্জন বসু। কিন্তু তাঁর ভাইপো প্রশান্ত বসু রিজেন্ট পার্ক থানায় শ্বাসরোধ করে খুনের অভিযোগ আনলেন শান্তাদেবী ও তাঁর নাতি রুদ্র ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে। পুলিশ ও গোয়েন্দারা অবশ্য প্রাথমিক তদন্তে দেখলেন, অসতর্কতায় মাংসের হাড় আটকেই মারা গিয়েছেন ওই ব্যক্তি। মৃতের ভাইপো খুনের মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।
গত ৩১ মার্চের ওই ঘটনায় অবশ্য অভিযোগ দেখে প্রথমেই গোলমাল মনে হওয়ায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেনি পুলিশ। কিন্তু ঠাকুরপুকুরে কীটনাশক খেয়ে সম্রাট চক্রবর্তী (২৫) নামে এক তরুণ আত্মহত্যা করার পরে এই ধরনের ভুয়ো অভিযোগে চরম হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে তাঁর সত্তরোর্ধ্ব ঠাকুর্দা ও ষাটোর্ধ্ব ঠাকুরমাকে। মৃতের দিদিমার কাছ থেকে তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ পেয়ে প্রাথমিক তদন্ত না-করেই ওই বৃদ্ধ দম্পতিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এ বছর কলকাতায় এখনও পর্যন্ত খুনের মামলা রুজু হয়েছে ৫৬টি। বছরের এখনও পাঁচ মাস বাকি, তার মধ্যে এই অঙ্কটা চমকে দেওয়ার মতোই। কিন্তু পুলিশের বক্তব্য, এর মধ্যে প্রকৃতই খুন হয়েছে ৪০টির আশপাশে, বাকি সবই খুনের ভুয়ো অভিযোগ। আর খুনের এই একের পর এক ভুয়ো অভিযোগের জেরে নাকাল হতে হচ্ছে স্থানীয় থানার পুলিশ ও লালবাজারের গোয়েন্দাদের। গত বছর কলকাতা পুলিশের কাছে খুনের মামলা রুজু হয়েছিল ৮৫টি এবং এর মধ্যে ৩০টিরও বেশি ছিল স্রেফ ভুয়ো অভিযোগ। এবং গত বছর থেকেই ওই প্রবণতা বেড়েছে বলে জানাচ্ছে পুলিশ।
যেমন, সার্ভে পার্ক এলাকায় জাম পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে মারা যান ৬১ বছরের নিরঞ্জন মিত্র। ২০১১-র ৩১ মে-র ঘটনা। ময়নাতদন্ত রিপোর্টও বলে, উঁচু থেকে পড়ে গিয়েই ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ২০১২-র ২৭ জুন মৃতের স্ত্রী পুষ্প মিত্র থানায় অভিযোগ করেন, যাঁর কাছে নিরঞ্জনবাবু কাজ করতেন, সেই বাবলু বসু ও অন্যান্য লোকজন তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। পুলিশি তদন্তে বেরোয়, বাবলু বসু পুষ্পদেবীকে দোকান করার জন্য অর্থসাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে তা না-রাখায় খুনের ওই ভুয়ো অভিযোগ আনা হয়েছে।
কিন্তু গত বছর থেকে খুনের মিথ্যা মামলা রুজু করার এই প্রবণতা হঠাৎ দেখা দিল কেন?
যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “খুনের ভুয়ো অভিযোগগুলির ৯৯ শতাংশই দায়ের করা হয়েছে সংযোজিত এলাকার থানাগুলিতে, ২০১১-র সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা থেকে যেগুলি কলকাতা পুলিশের আওতায় এসেছে। বিশেষত, তিলজলা, রিজেন্ট পার্ক, যাদবপুর, পূর্ব যাদবপুরের মতো থানায় এই প্রবণতা বেশি।”
লালবাজারের কর্তাদের একাংশের মতে, ওই থানাগুলি যখন রাজ্য পুলিশের অধীনে ছিল, তখন পরিকাঠামোগত অভাব ও অন্যান্য সমস্যার কারণে ভুয়ো অভিযোগ নেওয়া তো দূরস্থান, কথা না-বলে অভিযোগকারীকে থানা থেকে বার করে দেওয়াও হত। কিন্তু কলকাতা পুলিশের অধীনে আসার পর ওই সব এলাকার বাসিন্দাদের মনে হয়েছে, অভিযোগ দায়ের করলে পুলিশ নেবেই এবং তাতে প্রতিহিংসা চরিতার্থ বা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি হবে।
পল্লববাবুর বক্তব্য, “কেউ খুনের অভিযোগ দায়ের করলে আমরা মামলা রুজু করতে বাধ্য। কিন্তু যে-ভাবে সংযোজিত এলাকায় খুনের ভুয়ো অভিযোগ করার প্রবণতা বেড়ে চলেছে, তাতে আমাদের কাজের অসুবিধা হচ্ছে। এ বার আমরা আদালতে আবেদন করব, যাতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় ভুয়ো অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।” মিথ্যা অভিযোগের বিষয়টি প্রমাণিত হলে সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। |