ঘটনার সাত দিনের মাথায় ধরা পড়ল শহরে ফরাসি তরুণী হেনস্থায় মূল অভিযুক্ত। পুলিশ জানায়, মনোজ হালদার নামে ওই যুবক গোবিন্দপুর রোড এলাকার বাসিন্দা। তার নেতৃত্বেই ১৩ জুলাই রাতে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার সময়ে ফরাসি ওই তরুণী ও তাঁর সঙ্গীর উপরে চড়াও হয়েছিল দুষ্কৃতীরা।
পুলিশ জানতে পেরেছে, ফরাসি ওই তরুণ-তরুণীরা অন্ধকার গলির মধ্যে পালানোর চেষ্টা করলে মনোজের মোটরবাইকেই তাঁদের ধাওয়া করা হয়। মনোজেরা তাঁদের ইট ছুড়ে মারারও চেষ্টা করে। কিন্তু ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পরে পুলিশ প্রথমে বিষয়টিকে যথোচিত গুরুত্ব দেয়নি। তাই অভিযুক্তেরা কয়েক জন ধরা পড়লেও এক জন জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। পরে অবশ্য অভিযোগকারী যুবকের সঙ্গে ফের কথা বলে মামলাটি নতুন করে সাজায় পুলিশ। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ফরাসি তরুণী ও তাঁর সঙ্গী যুবককে খুনের চেষ্টার অভিযোগও দায়ের করা হয়। কিন্তু মূল অভিযুক্ত মনোজ এত দিন অধরাই ছিল। শনিবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ লেক এলাকার বাঙুর পার্ক থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া, জামিনে মুক্ত আর এক অভিযুক্ত কমল নস্করের জামিন নাকচের জন্য আলিপুর কোর্টে আবেদনও জানিয়েছে পুলিশ।
দেরিতে সক্রিয় হলেও পরবর্তী পর্যায়ে তদন্তে পুলিশের ভূমিকা সন্তোষজনক বলে মনে করছেন অনেকেই। যেমন কলকাতায় ফ্রান্সের কনসাল-জেনারেল ফাবরিস এতিয়েনও এক বার্তায় বলেছেন, “কলকাতা পুলিশ, বিশেষত লেক থানা কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে এবং আমার দেশের দুই সহনাগরিককেও সব রকমের সাহায্য করেছে। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।” এ দেশের বিচার ব্যবস্থার উপরেও তাঁর পূর্ণ আস্থা রয়েছে বলে তাঁর বার্তায় জানিয়েছেন ফাবরিস।
যোধপুর পার্ক এলাকায় ওই রাতে বিপন্ন তরুণ-তরুণীর পাশে দাঁড়াতে সে দিন এগিয়ে এসেছিলেন কয়েক জন স্থানীয় বাসিন্দা। ফরাসি কনসাল-জেনারেলও সে কথা স্মরণ করেছেন। এই অঘটনের জন্য ফরাসি নাগরিকদের প্রতি কলকাতার সহমর্মিতার কথাও ফাবরিস বারবার বলেছেন। তবু কলকাতাকে কাঁটার মতো বিঁধছে কয়েক জন উচ্ছৃঙ্খল যুবকের অভব্য আচরণ। পুলিশ সূত্রের খবর, মনোজ ছাড়া বাকি চার জনই যোধপুর পার্কের কাছে নিম্নবিত্ত মহল্লা রহিম ওস্তাগর রোডের বাসিন্দা। ফরাসি তরুণী হেনস্থা-কাণ্ডে ধৃত পাঁচ জনই ছোটখাটো কাজ করে অর্থ উপার্জন করে।
পুলিশ জানায়, বছর কুড়ির মনোজ একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে এটিএমে টাকা ভরার কাজ করে। ৩৫ বছর বয়সী কমল বেসরকারি বিমা সংস্থার এজেন্ট। ক্লাস সিক্সে স্কুলছুট ছোটু হালদার (২৬) গাড়ির ‘হেল্পার’। ১৯ বছরের নেপাল সর্দার ছোটুর শাগরেদ, কখনও-সখনও কেটারিংয়ের কাজেও ফাই-ফরমাশ খাটে। নেপালের সমবয়সী বাবাই হাজরা পাড়ায়-পাড়ায় ফুটবলের খেপ খেলে বেড়ায়। কারও নামেই বড়সড় অভিযোগ নেই। তবে বাবাই ছাড়া বাকিদের মদ খেয়ে গোলমালের ব্যাপারে ‘নামডাক’ রয়েছে। মনোজ ও বাবাই ছাড়া অন্যদের দু’-এক বার পুলিশের লক-আপেও ঢুকতে হয়েছে। লালবাজারের এক কর্তা বলেন, “আপাত ভাবে এরা কেউই দাগি দুষ্কৃতী নয়। কিন্তু অপরাধপ্রবণ হাব-ভাবের ছেলে। এই ধরনের তরুণেরাই মাঝেমধ্যে বড়সড় দুষ্কর্ম করছে। তাদের ব্যাপারে থানায় থানায় সতর্কতার জায়গায় আমাদের ভাল মতো খামতি দেখা যাচ্ছে।”
অভিযুক্তদের মধ্যে কমলকে ঘটনার পরদিন, রবিবার ধরেছিল পুলিশ। পরে বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া হতে মঙ্গলবার রাতে নেপাল, বুবাই, ছোটুদের গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু মনোজের খোঁজ মিলছিল না। এক পুলিশকর্তা জানান, তাকে পাকড়াও করতে এলাকার ‘সোর্স’দের কাজে লাগায় পুলিশ।
এক সপ্তাহ আগে (১৩ জুলাই) ফরাসি ‘জাতীয় দিবস’ উদযাপনের রাতেই ফরাসি ওই তরুণ-তরুণীকে হেনস্থার ঘটনাটি ঘটেছিল। পুলিশ জানায়, ওই তরুণী ফরাসি দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্যু বেঙ্গাল’-এ ইন্টার্নশিপ করতে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গী যুবকও সেখানেই উচ্চপদে কর্মরত। অনুষ্ঠান শেষে গড়িয়াহাটে এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলেন তাঁরা। তার পরে রাত আড়াইটে নাগাদ যোধপুর পার্কে ফিরছিলেন। তখনই মোটরবাইক নিয়ে একদল যুবক ওই তরুণীকে ধাওয়া করে। তাঁর উদ্দেশে কুৎসিত মন্তব্য করে তারা। তরুণীর সহকর্মী যুবক এর প্রতিবাদ করলে তাঁকে মারধরও করে দুষ্কৃতীরা। অভিযোগ, মনোজেরা রাস্তা থেকে একটি ইট নিয়ে ফরাসি ওই যুবককে ছুড়ে মারে। সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় বেঁচে যান তিনি। প্রাণের ভয়ে ওই তরুণী একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির কাছে লুকিয়ে পড়েন। শেষে স্থানীয়দের সাহায্যেই রেহাই পান তাঁরা।
রবিবার লেক থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ওই তরুণীর সহকর্মী। ঘটনার আতঙ্কে ইন্টার্নশিপের মেয়াদ শেষের আগেই শহর ছেড়ে দেশে ফিরে গিয়েছেন তরুণী। |