ধূমপানের চেয়ে কম কিছু নয় ঠায় বসে থাকার বিপদ
দু’জনে একই অফিসের কর্মী। বসেন পাশাপাশি।
এক জনের সিগারেটের নেশা, সঙ্গে জর্দা-পান। আর এক জন সিগারেট-বিড়ি তো ছোঁনই না, পান, জর্দা বা গুটখা কিছুরই নেশা নেই। শুধু দিনে দু’কাপ চা। তা নিজের টেবিলেই খেয়ে নেন। বস্তুত যে সাত-আট ঘণ্টা তিনি অফিসে থাকেন, একনাগাড়ে বসে কাজ করে যান। কাজ শেষ হলেও বসে বসে নেট সার্ফ করেন কিংবা বই পড়েন। অফিস ছাড়ার আগে চেয়ার ছাড়েন কালেভদ্রে।
প্রথম জনকে ডাক্তার বার বার বলেছেন সিগারেট-জর্দা বর্জন করতে। ক্যানসার ছাড়াও ধূমপানের ফলে অন্য কী কী বিপদ হতে পারে, সে সম্পর্কে বহু বার সতর্ক করেছেন। কিন্তু সেই একই বিপদের বার্তা এ বার দ্বিতীয় জনকেও দিচ্ছেন ডাক্তারেরা, যিনি কি না কস্মিনকালে ওই সব নেশার ধার-কাছও মাড়াননি! কেন?
কারণ, ওঁর দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার অভ্যেস। যা ধূমপানের মতো প্রায় একই রকম বিপজ্জনক বলে রায় দিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা। আশঙ্কাটা অনেক দিন ধরেই ছিল। এখন পরিষ্কারই বলা হচ্ছে, সিগারেট-দোক্তার মতো চেয়ার-সোফাও কঠিন রোগের উৎস! তামাকের নেশা থাকলে যেমন হৃদ্রোগ, ব্রেন স্ট্রোক, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, রক্তচাপবৃদ্ধির প্রবণতা বাড়ে, তেমন দিনের পর দিন দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলেও শরীরে একই প্রভাব পড়ার ষোলো আনা আশঙ্কা। তাঁরাও একই ধরনের রোগজ্বালায় আক্রান্ত হতে পারেন।
এ হেন স্পষ্ট হুঁশিয়ারিটি সম্প্রতি দিয়েছেন মার্কিন মুলুকের চিকিৎসকেরা। গত জুনে শিকোগোয় ‘আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর বার্ষিক সম্মেলনে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সন্দেহ নেই, দীর্ঘক্ষণ চেয়ারে বসে থাকা ক্ষতিকর। কর্মস্থলে এর বিকল্প কী হতে পারে, তা দেখা জরুরি।’ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কম্পিউটারে কাজ করার ব্যবস্থা এবং ‘আইসোমেট্রিক বল’-এর মতো শারীরিক কসরতের কিছু জিনিস অফিসে মজুত রাখার পক্ষেও সওয়াল করেছে অ্যাসোসিয়েশন।
এবং এ প্রসঙ্গে কাজের ধরন-ধারণের পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্মের ‘অতিরিক্ত প্রাযুক্তিক’ মানসিকতার বিষয়টিও উঠে আসছে। চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য: এখন আইটি সেক্টর থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক, মিডিয়ার মতো বহু ক্ষেত্রে একটানা বসে কাজ করাটাই দস্তুর। আবার অল্পবয়সীদের মধ্যে বাড়িতেও বসে থাকার প্রবণতা বাড়ছে। “ছোটবেলায় পড়াশুনোর চাপে বই থেকে মুখ তোলার যো নেই। ফাঁক পেলেই টিভি খুলে বা কম্পিউটার চালিয়ে বসে পড়া। বড় হয়েও এটাই চলছে। পরে ফল ভুগছে।” মন্তব্য এক চিকিৎসকের। হৃদ্রোগ-বিশেষজ্ঞ শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “হাঁটাহাটির অভ্যেস কোথায়? বাড়ি থেকে গাড়িতে অফিস। সিঁড়ির বদলে লিফ্ট। গিয়েই চেয়ারে বসে কাজ শুরু। নড়াচড়ার বালাই নেই। সমস্যার শিকড় এখানেই।” শুভ্রবাবুর ব্যাখ্যা, “একটা রোগের সঙ্গে আর একটার সম্পর্ক থাকে। যেমন ওবেসিটি (স্থূলত্ব) থেকে ডায়াবেটিস হতে পারে, ব্লাড প্রেসার বাড়তে পারে। তাতে হার্টে গণ্ডগোলের সম্ভাবনা। আজকাল অনেক অল্পবয়সীরও হাই প্রেসার। দীর্ঘ সময় বসে থাকা এর অন্যতম কারণ।” ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটক বলছেন, “এক-দুু’ঘণ্টা বসে থাকার কথা হচ্ছে না। নিয়মিত সাত-আট ঘণ্টা ঠায় বসে থাকা ভাল নয়। লক্ষ বছরের চেষ্টায় আদিম মানুষ হাঁটা, দৌড়ের রীতিনীতি শিখেছে। এখন অভিযোজনের বিরুদ্ধে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ারে বন্দি থাকছেন অনেকে। প্রকৃতির নিয়ম ভাঙার শাস্তি তো পেতেই হবে!”
ক্ষতি হয় কেন? চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা: চলাফেরায় যে সব পেশি ব্যবহার হয়, দিনের পর দিন দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে তার কর্মক্ষমতা কমতে থাকে। পেশিগুলোর ঘনত্ব, শক্তি কমে যায়। নষ্ট হয় কোলাজেন তন্তুর নমনীয়তা। ওঁরা বলছেন, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত ও অক্সিজেন পাঠায়। কায়িক পরিশ্রমের সময়ে সংশ্লিষ্ট অঙ্গের কোষে কোষে বাড়তি অক্সিজেনের দরকার পড়লে হৃৎপিণ্ড সেখানে অধিক অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত পাঠাতে থাকে। কিন্তু বসে থাকলে চলাফেরার পেশির কাজ থমকে যায়, সেখানে অক্সিজেনের চাহিদা কমে। হার্টও বেশি রক্ত পাঠায় না। নিয়মিত দীর্ঘ সময় ধরে তা হতে থাকলে সংশ্লিষ্ট পেশির কোষগুলোর কর্মক্ষমতা তো কমেই, হার্টের সক্রিয়তাও হ্রাস পায়। “যেমন ধরুন, দোকানে প্রচুর জিনিসপত্র মজুত, অথচ ক্রেতা নেই। লোকসানের জন্য দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। একই ভাবে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সঞ্চালনের কাজ কমে গেলে হার্টের ক্ষমতাও নষ্ট হতে বাধ্য।” দাবি মৌলিমাধববাবুর।
আমেরিকার চিকিৎসকেরাও জানিয়েছেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শরীরে সব সময় ডায়াবেটিস প্রতিরোধক ইনসুলিন তৈরি হয়। বসে থাকলে যে সব অঙ্গ কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকে, সেখানে ইনসুলিনের চাহিদা কমে। ফলে ইনসুলিন-উৎপাদক অঙ্গ, অর্থাৎ প্যানক্রিয়াসের ক্ষমতা কমে। এ ভাবে ডায়াবেটিসের প্রকোপে পড়ছেন অনেকে। আবার ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল নষ্ট করে যে ‘লাইপোপ্রোটিন লাইপেজ’ এনজাইম, তার উৎপাদনও একই ভাবে ব্যাহত হয়। এতে বাড়ে হৃদ্রোগ, ব্রেন স্ট্রোকের আশঙ্কা।
পরিত্রাণের উপায় কী?
মৌলিমাধববাবুর দাওয়াই, “অফিসে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারলে ভাল। শুনলে হাস্যকর শোনাবে, তবে পারলে জরুরি বৈঠকও হেঁটে হেঁটে করা যেতে পারে। বর্তমানে কম্পিউটার-ভিত্তিক কাজ বেশি। যন্ত্রটিকে দাঁড়িয়ে কাজ করার মতো সুবিধাজনক জায়গায় রাখা যেতে পারে।” এ ছাড়া বসে-বসেও সহজ কয়েকটি ব্যায়াম করা যায়। কাজের মধ্যে আধ ঘণ্টার ব্যবধানে দু’মিনিট হাঁটা যায়। তাতে গ্লুকোজ উৎপাদনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা।

সাত পরামর্শ
• অফিসে একটানা বসে কাজ নয়
• আধ ঘণ্টা কাজের পরে দু’মিনিট হাঁটুন
• কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করুন
• প্রয়োজনে কম্পিউটারেও দাঁড়িয়ে কাজ
• অফিসে লাঞ্চ সারুন দাঁড়িয়ে
• বসে বসেই সহজ কিছু ব্যায়াম
• টিভি’র সামনে টানা বসবেন না



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.