লাগোয়া তিন জেলায় পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠল কলকাতা সংলগ্ন বিস্তীর্ণ শহরতলি এলাকা। কোথাও অবরোধ, কোথাও অবরোধ তোলার ‘অভিযান’, কোথাও হামলা, কোথাও মারধরের অভিযোগ। আর অধিকাংশ জায়গাতেই অভিযোগ উঠল পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে। যার জের শেষমেশ ভুগতে হল সাধারণ মানুষকেই। এমনিতেই পথে বাস না থাকায় দুর্ভোগ ছিল যথেষ্ট। তার উপরে গোলমালের জেরে ভোগান্তি বাড়ল আরও।
পঞ্চায়েতে সন্ত্রাস হলেই পথে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন বাম নেতারা। শুক্রবার নির্বাচন শুরু হতেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে বুথ দখল, কর্মীদের মারধর, ভোটারদের বাধাদান-সহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠতে শুরু করে। এর পরেই প্রথমে নৈহাটিতে পথ অবরোধ দিয়ে অবরোধের অভিযান শুরু করে সিপিএম। শ্যামনগরে রেল অবরোধও করে তারা। অবরোধ হয় দমদম, মধ্যমগ্রাম রেলস্টেশনেও। অন্য দিকে সোদপুর, ডানলপ মোড়, মধ্যমগ্রাম চৌমাথা, বিরাটি, লেকটাউন, বিমানবন্দরের ১ নম্বর গেট-সহ বিটি রোড, ভিআইপি ও যশোহর রোডের বিভিন্ন জায়গায় অবরোধে দিনভর দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে। দুপুর ১টা থেকে দমদম রেল স্টেশনে অবরোধ হয়। আটকে পড়ে এক্সপ্রেস-সহ বিভিন্ন ট্রেন। শিয়ালদহমুখী ট্রেনগুলি আটকে পড়ায় যাত্রীদের নেমে হাঁটতে হয়। |
তৃণমূলের তরফে কোনও ঘোষিত কর্মসূচি না থাকলেও তারাও থেমে ছিল না। যেখানে যেখানে অবরোধ হয়েছে, সেখানে পুলিশের বদলে তৃণমূল কর্মীরাই ‘গায়ের জোরে’ অবরোধ তুলে দেন বলে অভিযোগ। কর্মীদের এই অভিযানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন খোদ পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। অবরোধ হলে এ ভাবেই আটকানো হবে বলে পাল্টা হুঁশিয়ারি দেন তিনি। যদিও প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। তবে অভিযোগ, তারা কার্যত নীরব দর্শক হয়েই ছিল। অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পুলিশকর্তারা।
দুপুর বারোটার পরে সিপিএমের কর্মীরা রেলস্টেশন অবরোধ করতে গেলে পথে নামেন তৃণমূল কর্মীরা। এই নিয়ে দু’পক্ষের গোলমাল চরমে ওঠে। সিপিএমের অভিযোগ, তৃণমূলের বাহিনী তাঁদের উপরে হামলা চালায়। বাদ যাননি মহিলারাও।
একই ঘটনা ঘটে বিটি রোডের ডানলপ মোড়ে। সেখানে দুপুর একটায় সিপিএম পথ অবরোধ করতে গেলে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় গোটা এলাকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডানলপ মোড়ের চার দিকের রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। তবে অবরোধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পুলিশ এলেও অবরোধ হটানোর দায়িত্ব নেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। তবে স্থানীয় তৃণমূল নেতা অঞ্জন পাল-সহ কয়েক জন ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। যদিও বামেদের অভিযোগ, মহিলা-সহ বেশ কয়েক জন কর্মী ওই ঘটনায় আহত হয়েছেন। তৃণমূল নেতৃত্বের পাল্টা অভিযোগ, সিপিএম কর্মীরা এ দিন মারমুখী ছিল। দু’টি অ্যাম্বুল্যান্স আটকে দেয়, একটি গাড়ির চাবি কেড়ে নেয় তারা। এর জেরেই গোলমালের সূত্রপাত বলে তৃণমূলের দাবি। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাম নেতারা।
বিটি রোডের এই ঘটনায় কিছুক্ষণের মধ্যেই সদলবলে হাজির হন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। কেন পুলিশের বদলে তাঁদের কর্মীরা ‘গায়ের জোরে’ সিপিএমের অবরোধ হটাল? জবাবে মন্ত্রী বলেন, “গায়ের জোরেই অবরোধ হটানো হবে। মানুষের সমস্যা করলে এটাই করা হবে। হটাতে হটাতে হাসনাবাদ পার করে দেব।” তাঁর দাবি, মানুষও এ সব বরদাস্ত করবেন না। তাঁরাই প্রতিরোধ করবেন।
পাল্টা অভিযোগে সিপিএম নেতা অশোক রায় বলেন, “ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে তৃণমূল। আমাদের ঘোষিত কর্মসূচি ছিল। কোনও অ্যাম্বুল্যান্স আটকানো হয়নি। মদের বোতল থেকে লোহার রড, হকিস্টিক নিয়ে তৃণমূল হামলা করল, পুলিশ শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল।” |
শুধু বিটি রোডই নয়, ভিআইপি রোডে লেকটাউন মোড়, যশোহর রোডে মধ্যমগ্রাম চৌমাথাতেও পথ অবরোধ করেন সিপিএম কর্মীরা। তবে পথচারী ও যাত্রীদের অভিযোগ, এক দল সন্ত্রাসের নামে পথ আটকাল, অপর পক্ষ যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে অবরোধকারীদের মারধর করল। আর পুলিশ পুরোটাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা এতটুকুও কমল না, বরং বেড়ে গেল। ডানকুনির বাসিন্দা রমেন আদক বলেন, “বাস ধরব বলে আমরা বেশ কয়েক জন ডানলপ মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সিপিএম অবরোধ করল, তৃণমূল পাল্টা মারল। পুলিশ দেখল। দু’দলের গোলমালে ভয়ে যে দিক পারলাম দৌড়ে পালালাম।”
দুপুর একটা নাগাদ সিপিএমের নেতা-কর্মীরা লেকটাউন মোড় অবরোধ করলে এক দিকে বাগুইআটি, অন্য দিকে উল্টোডাঙা পর্যন্ত যানজট ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে অবরোধ চলে। পুলিশকর্তারা ঘটনাস্থলে গেলে আলোচনার পরে অবরোধ তুলে নেন বামনেতারা।
দুপুর সাড়ে তিনটের কিছু পরে বিমানবন্দরের কাছে ১ নম্বর গেটের মোড়ে অবরোধে বসেন সিপিএমের কর্মীরা। এর জেরে এক দিকে যশোহর রোড, অন্য দিকে ভিআইপি রোডে সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। দ্রুত পুলিশ গিয়ে অবরোধকারীদের সরিয়ে দেয়। যাত্রীদের অভিযোগ, সকাল থেকে বাস অনেক কম, উপরন্তু দফায় দফায় অবরোধ, গোলমাল। সব মিলিয়ে দমবন্ধকর পরিস্থিতি। যেমন, এক আত্মীয়কে আনতে কলকাতা বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন মানিকতলার গৌতম রায়। পথেই অবরোধের জেরে আটকে পড়েন। গৌতমবাবু বলেন, “আইনকানুন বলে যে কিছু নেই, হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছি। যেমন শাসক, তেমনি বিরোধী দল। পুলিশ বলেও কিছু নেই! সাধারণ মানুষের সুবিধা বা সমস্যার কথা কেউ ভাবছে না।”
|