হাতের তালুর মতো আঁকিবুঁকি কাটা খাল-বিল-বাওড় উজিয়ে ছোট্ট জনপদ, চরযাত্রাসিদ্ধি।
হাজার-বারোশো দেহাতি মানুষের সেই গ্রাম এখন কার?
কপালে হাত ঠেকিয়ে সাধুচরণ মাহাতো বলেন, “সাচ কহে তো অভি হম স্রিফ চুনাওকি হ্যায়। পঞ্চায়েত কি ইয়ে চুনাও হমারা আপনা হ্যায়, বাবু।”
লাল, গেরুয়া, সবুজসব ভুলে চরযাত্রাসিদ্ধি এখন তাদের ‘একান্ত আপন’ পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমগ্ন।
গ্রামের চৌহদ্দি জুড়ে কোমর জলে ডুবে থাকা মরা-ভুট্টার খেত। বাঁশের খুঁটিতে ধ্যানী মাছরাঙা আর গোড়ালি ডোবা প্যাচপ্যাচে কাদা। বানভাসির এই নিত্য রোজনামচা তো তাঁদের সম্বৎসরের চেনা। সেই চেনা কষ্টে, পঁয়ত্রিশ বছর পরে ‘অচেনা’ নিবার্চনের ভরসায় বুক বেঁধেছে চরযাত্রাসিদ্ধি।
ভোটার তালিকায় ওঁরা সব্বাই আছেন, সাধুচরণ, রামচরিত, রামসাগর মাহাতো। তবু দেখা হলেই পরস্পরের কুশল বিনিময়ের মতো আওড়াচ্ছেন, ‘ভোটার লিস্টিমে নাম হ্যায় তো!’ গ্রামের এক মাত্র শ্যাওলা ধরা প্রাথমিক স্কুলটার পরিচয়ই বদলে গিয়েছে, ‘হমারা বুথ’। বাকি পৃথিবীর সঙ্গে এক টুকরো বাঁশের সাঁকো দিয়ে জুড়ে থাকা গ্রামটা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের নিরিখে পরিচয় খুঁজে পেয়েছে। গত সাড়ে তিন দশক ধরে যে পরিচয়টাই হাতড়ে বেরিয়েছে চরযাত্রাসিদ্ধি। |
হুগলি না নদিয়া, গ্রামটা কোন জেলার, তা নিয়ে প্রশাসনিক লড়াইয়ে নিজেদের ঠিকানাটাই হারিয়ে ফেলেছিল চরযাত্রাসিদ্ধি। হারিয়ে গিয়েছিল গ্রামীণ মানুষগুলোর আত্মপরিচয়টাই। কেন? অশীতিপর রামনাথ মাহাতো বলেন, “বাড়ির ঠিকানা না থাকলে নিজের পরিচয় থাকে? আমরা কোন জেলার, কোন পঞ্চায়েতের বাসিন্দা তারই তো ঠিকানা ছিল না।”
ব্যান্ডেল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে গঙ্গা যেখানে বাঁক নিয়েছে, গ্রামটা আদতে ছিল ঠিক তার উল্টো পাড়ে। নদী আর ভূখণ্ডের মাঝে বছরভর শরবন আর শীতকালে বেগুন, কপি, ভেন্ডির আবাদ নিয়ে পড়ে থাকা এক চিলতে চর। পাঁচ-সাত পুরুষ আগে ঝাড়খণ্ডের ‘মুলুক’ ছেড়ে আসা মাহাতোদের খাস সাকিন। ঠিকানা ছিল: পঞ্চায়েত-চন্দ্রহাটি-১, ব্লক-বলাগড়, জেলা-হুগলি। কাটোয়া লোকসভা এবং বলাগড় বিধানসভার অর্ন্তভূক্ত
গ্রামটার সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ বলতে সবেধন ওই এক চিলতে চর।
সত্তর দশকের মাঝের বছরগুলিতে গঙ্গা তার পথ বদলাতে থাকে। চরযাত্রাসিদ্ধিকে পিছু ফেলে ক্রমেই সে সরে যেতে থাকে আরও পশ্চিমে। নদীর মরা খাতে জোয়ার-ভাটা আর বৃষ্টির জমা জলে গ্রাম ঘিরে সৃষ্টি হয় অজস্র খাল বিল। বছর কয়েকের মধ্যেই ওপারের মূল ভূখণ্ড থেকে ছিন্ন হয়ে জলবেষ্ঠিত, কার্যত একটি দ্বীপের চেহারা নেয় চরযাত্রাসিদ্ধি। সেই সঙ্গে হুগলি জেলার সঙ্গে সরু ফিতের মতো লেগে থাকা সম্পর্কটাও ভেসে যায় চিরতরে। ঠিকান হারা সেই গ্রামের সামনে ঝুলে থাকে প্রশ্ন চরযাত্রাসিদ্ধি তুমি কার? হুগলি না নদিয়া, কোন জেলার? সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি বলেই এতগুলো বছর ধরে নির্বাচন দেখেনি সেই গ্রাম।
১৯৭৮ সালে শেষ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল ওই গ্রাম। তারপর জোয়ার-ভাটার মতো অনর্গল নির্বাচনের উত্তাপ শুধু দূর থেকেই দেখেছেন সাধুচরণরা। ২০০৯ সালে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার দেবাশিস সেনের বিশেষ উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত গ্রামের ঠিকানা নির্দিষ্ট হয়পঞ্চায়েত কাঁচরাপাড়া, ব্লক চাকদহ, জেলা নদিয়া। দেবাশিসবাবুরও মনে আছে সে গ্রামের কথা। বলছেন, “গ্রামীণ মানুষগুলো ভোট দেওয়ার জন্য একেবারে মুখিয়ে ছিল। ওঁরা ভোট দিতে পারছেন শুনেই ভাল লাগছে।”
গ্রাম সংসদে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন প্রতিমা চৌধুরী। তুলসিতলায় পুজো সেরে সদ্য তরুণী প্রার্থী বলছেন, “ও সব বড় নেতাদের ভোট! পঞ্চায়েতের ভোট হল মেরা আপনা ভোট। কে কোন দলের সেটা বড় কথা নয়। আমাদের গ্রামে ভোট হচ্ছে, ইয়েহি হ্যায় আসলি বাত।” দলের নেতাদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় টেবিল চিহ্নে গোঁজ প্রার্থীও পড়েছে তৃণমূলের, হৈমন্তী মাহাতো। তিনি বলেন, “যেই জিতুক গ্রাম থেকেই তো জিতবে!” সিপিএমের রিনা মাহাতোর সঙ্গে প্রতিপক্ষদের সমান সখ্য। উঠোনে ঘুঁটে দেওয়ার ফাঁকে বলছেন, “কে টিএমসি, কে সিপিএম সেটা বড় কথা নয়। পহেলে তো হাম পড়োশি হ্যায়।”
নদী, খাল-বিল উজিয়ে ৯৮২ জন ভোটারের বিচ্ছিন্ন চরযাত্রাসিদ্ধির ‘আপনা চুনাও’এ সেটাই তো হক কথা! |