|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
রাজকীয় নিসর্গের রাজরপ্পা
পাহাড়-মাটির স্তূপের মধ্য দিয়ে অগুন্তি ছোট-বড় নদী আর
পাহাড়ের
কোল ঘেঁষে নিঃশব্দে ঝরে পড়া ঝোরার
কলকাকলি।
লিখছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় |
|
|
মাঘের রোদ পিঠে লাগিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাঁচি থেকে একটা গাড়ি নিয়ে রাজরপ্পার দিকে। রামগড় থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে, আর রাঁচি থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে রামগড় ও চিতোরপুর রোডের উপরেই রাজরপ্পা। হাজারিবাগ রোড ধরে খেলগাঁও-এর দিকে চলতে লাগলাম। ন্যাশনাল হাইওয়ে ৩৩-এর উপরে ঝকঝকে সাজানো আর্মি ক্যান্টনমেন্ট ‘দীপাটলি’ এল।
ছোটনাগপুর মালভূমির সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁষে আমাদের চলা। বেশ মনোরম জলবায়ু আর সবুজ প্রকৃতি। কিছু পরেই এল রামগড় ঘাঁটি। একটু চড়াই আবার সামান্য উতরাই পথ দিয়ে চলতে চলতে পলামু, মনে পড়ছিল সঞ্জীবচন্দ্র, বিভূতিভূষণ। গাড়ির কাচ খুলে নাম না জানা, অচেনা ফুলের বুনো গন্ধ নিতে নিতে ভাবছিলাম অধুনা ঝাড়খণ্ডের এই অংশটির কথা। বৈচিত্রময় ঝাড়খণ্ডের এই ভূখণ্ডটির সম্পদ হল পাহাড়-মাটির স্তূপের মধ্য দিয়ে অগুন্তি ছোট বড় নদী আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নিঃশব্দে ঝরে পড়া ঝোরার কলকাকলি।
|
|
সে বার গিয়েছিলাম রাঁচি থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে দশম ফলস। মনে পড়ছিল সেই কথা। কী অপূর্ব সেই রূপ! সুবর্ণরেখা নদীর এক শাখা কাঁচির দশটি ধারা অবলীলায় ৪৪ মিটার উপর থেকে একসঙ্গে ঝরে পড়ছে নীচে। এ ছাড়াও হুড্রু, জোনহা, হিরানি, পাঁচ গাঘ ফলস, সীতা ফলস, কাঁকে ড্যাম, রাঁচি লেক, ছোটনাগপুর মালভূমির এই অংশটি ঘিরে যেন এক প্রাকৃতিক নবরত্নের মালা গেঁথে সাজিয়ে রেখেছে নিখুঁত ভাবে। আর সাঁওতাল মানুষের জীবনযাপন, ধামসা-মাদল, অনবরত ঝরে পড়ে থাকা বিশাল বিশাল ভূর্জপত্রের উপর লিখে রেখে যায় কত সময়ের দলিল। বছরের পর বছর ধরে এ সব পুরনো হয় না। মহুয়ার ঝিম ধরা নেশার মতো সেই গল্প উঠে আসে বার বার কত লেখকের কলমে, বীরসা মুন্ডার জীবনযুদ্ধে। এখানকার সবচেয়ে বড় নদী দামোদর। রাঁচি ও হাজারিবাগ মালভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের আর এক নদী ভৈরবী বা ভেরার সঙ্গে মিলিত হয়েছে দামোদর আর সেই সঙ্গমেই রাজরপ্পা জলপ্রপাত। প্রায় ন’মিটার উঁচু থেকে ভেরা নদীর অবিরত ধারা ঝরেছে দামোদরের বুকে। রাজরপ্পা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয়, ছিন্নমস্তা বা ছিন্নমস্তিকার মন্দিরের জন্যও যথেষ্ট বিখ্যাত। কিংবদন্তি অনুসারে সতীর দেহত্যাগের পরে মহাদেবের তাণ্ডবনৃত্যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন সতীর মস্তকটি নাকি এখানে পড়েছিল, তাই দশমহাবিদ্যার অন্যতম ছিন্নমস্তা মায়ের মন্দিরটি একান্ন সতীপীঠের একটি বলে অনেকেই দাবি করেন। সতীপীঠ হোক বা
না হোক, গাড়ি নীচে রেখে সামান্য চড়াই
পাহাড়ি পথ ধরে মন্দিরের দিকে এগোতে লাগলাম।
বহু দিন আগে, যখন এই রাস্তা হয়নি তখন নদী পেরিয়ে মন্দিরে আসতে হত। এখন রাজরপ্পা অনেকটাই আধুনিক এবং কংক্রিটের বাহুল্যে কিছুটা হলেও কৃত্রিম। |
|
তবে দেবী ছিন্নমস্তার মন্দির এবং রাজরপ্পা জলপ্রপাতটি ভুলিয়ে দেয় সব কিছু। অনেকটা কামাখ্যা মন্দিরের ঢঙে নির্মিত মূল মন্দিরটি। আর এই মন্দিরকে ঘিরে দশমহাবিদ্যা রূপের অন্যগুলি, অর্থাৎ কালী, তারা, কমলা, বগলা, ভৈরবী, ধূমাবতী, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, মাতঙ্গী প্রভৃতির মন্দির তৈরি হয়েছে অনেক পরে। মন্দির-চত্বরে দর্শনার্থীদের বিশাল লাইন দেখে ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু কিছু পরেই অতি সুন্দর নিয়ম মেনে লাইন এগোতে দেখলাম আর এক সঙ্গে জনা কুড়ি মানুষকে পুজো দিতে সম্মতি দেওয়া হয়। কোনও পান্ডার উপদ্রব নেই। আর অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ভাবে পুজো দেওয়া যায়। তাই গাড়ির চালককে লাইন রাখতে বলে পুজোর ডালি কিনে নিয়ে ঘুরতে গেলাম নদীর ধারে। নৌকো করে ও পারে যাচ্ছে মানুষ। আর দুই নদীর সঙ্গমে রাজরপ্পা ঝোরার কলকাকলি দারুণ সুন্দর।
তখন দুপুর একটা। সারি সারি শালগাছের মাথায় দুপুরের সজাগ সূর্য। আশেপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে দু-এক ঘর সাঁওতালি বসতি। লাইন দিয়ে দেবী ছিন্নমস্তার মন্দিরে প্রবেশ করলাম এক গা ছমছম অনুভূতি নিয়ে। সিঁদুর লেপা পাথরের গায়ে খোদাই করা একটা মুখ। অন্ধকারে ভাল বোঝা গেল না। তবে পুজো নিয়ে অহেতুক আড়ম্বর নেই। পূজারীর দাদাগিরিও নেই। সেটাই বেশ ভাল লাগল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসেছেন পুজো দিতে। স্থানীয় সাঁওতালেরা দেবী ছিন্নমস্তাকে অসম্ভব ভক্তি করেন এবং তাদের মৃত মানুষের অস্থিভস্ম এই দামোদর নদীতে ফেলেন। মন্দির থেকে নেমে যেতে হয় কালভৈরবের কাছে। নারকোল ভেঙে জল ঢেলে শিবের প্রণাম হল। তার পরে আবার দুই নদীর সঙ্গমস্থল পেরিয়ে তীরে উঠে গাড়ির খোঁজ করা।
|
|
কখন যাবেন |
বর্ষাকালে গেলে জলপ্রপাতগুলির থইথই রূপলাবণ্য দেখা যায়। এ ছাড়া
রাজরপ্পা
নভেম্বর থেকে মার্চ অবধি যাওয়াই শ্রেয়। কারণ
গরমের সময়
প্রচণ্ড দাবদাহ চলে এই অঞ্চলে।
|
কী ভাবে যাবেন |
হাওড়া থেকে রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেসে রাঁচি ও সেখান
থেকে গাড়ি ভাড়া করে রাজরপ্পা যাওয়া যায়। |
কোথায় থাকবেন |
রাঁচি শহরে বহু হোটেল আছে। বিশেষ ছুটির সময়
গেলে আগে থেকে বুক করে যাওয়াই ভাল। |
|
ছবি: রঞ্জন মুখোপাধ্যায় |
|
|
|
|
|