বিদেশি বিনিয়োগের উপর নির্ভর না করিয়া ভারতের উপায় নাই— যে দেশের বাণিজ্য খাতে ঘাটতি মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৪.৮ শতাংশে ঠেকে, সেই দেশে অন্য উপায় থাকে না। সেই বিনিয়োগের রাস্তা সুগম করিতে বুধবার সিদ্ধান্ত হইল, এই দেশে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ করিতে আর ফরেন ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন বোর্ড নামক কালান্তক লালফিতার ফাঁস পার হইতে হইবে না। এবং, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো হইল টেলিকমে যেমন ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি মিলিল। জোড়া সিদ্ধান্তের দৌলতে কিছু বিনিয়োগ আসিবে, অনুমান করা চলে। অন্তত, ২০১২-১৩ সালে যেমন বিদেশি বিনিয়োগ ৩৮ শতাংশ হ্রাস পাইয়াছিল, সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইবে না। কিন্তু আজ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের রাস্তা সাফ করা হইয়াছে বলিয়া কাল হইতে ভারতের দরজায় বিনিয়োগকারীদের লাইন পড়িয়া যাইবে এমন আশা না করাই ভাল। বস্তুত, যে দিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই ঘোষণা করিল, সেই দিন এবং তাহার পরের দিন ভারত প্রায় সত্তর হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হারাইল। পস্কো জানাইল, কর্নাটকে ৩০,০০০ কোটি টাকার ইস্পাত কারখানার প্রকল্পটি বাতিল করা হইয়াছে; আর্সেলর-মিত্তলও ঘোষণা করিল, ওড়িশায় ৪০,০০০ কোটি টাকার ইস্পাত কারখানা আর তৈরি হইবে না। বিদেশি বিনিয়োগের পথ সুগম করিবার সিদ্ধান্তের সঙ্গে এই দুইটি ঘোষণার দিন মিলিয়া যাওয়া নিতান্ত সমাপতন হইতেই পারে কিন্তু তাহাকে প্রতীকী হিসাবে দেখাই বাঞ্ছনীয়। কেবলমাত্র আইন বদলাইয়াই যে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো যাইবে না, এই সত্যটির প্রতীক।
ভারতে কেন বিদেশি বিনিয়োগ আসিতে চাহে না, তাহার কারণটি কেন্দ্রীয় সরকার ব্যতীত আর সকলেই জানেন। এই দেশে ব্যবসা করিবার পরিবেশ নাই। প্রতি বৎসর গোটা দুনিয়ার প্রায় সব দেশকে অন্তর্ভুক্ত করিয়া ‘ডুয়িং বিজনেস’ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। কোন দেশে ব্যবসা করা কতখানি সহজ, সেই নিরিখে ১৮৫টি দেশের মধ্যে ভারত ১৩২তম স্থানে আছে। কোনও আইনি চুক্তি কার্যকর করিবার ক্ষেত্রে ভারতের স্থান ১৮৪তম। নির্মাণের অনুমতিপত্র পাইবার সময়ের নিরিখে ১৮২তম; ব্যবসা আরম্ভ করিতে ন্যূনতম সময়ের নিরিখে ১৭৩তম; আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যোগদানের সুবিধার নিরিখে ১২৭তম। এই দেশে ব্যবসা আরম্ভ করিবার পূর্বে ১২দফা অনুমতি আদায় করিতে হয়। তাহার উপর আছে সরকারের গয়ংগচ্ছ মনোভাব, এবং সবার উপরে সর্বগ্রাসী, সর্বব্যাপী দুর্নীতি। নিতান্ত প্রাণের দায় না থাকিলে এমন দেশে কে বিনিয়োগ করিতে চাহিবেন? বিদেশি বিনিয়োগ দূরের কথা, ভারতীয় বিনিয়োগকারীরাও ক্রমে বিদেশে বিনিয়োগের পথে হাঁটিতেছেন। ক্রমে বোঝা যাইতেছে, ভারতে প্রশিক্ষিত কর্মীও নিতান্ত অপ্রতুল। দেশের উচ্চমানের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে সমীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, মোট ছাত্রসংখ্যার অতি সামান্য অংশ আধুনিক দুনিয়ায় চাকুরি করিবার যোগ্য। ফলে লোক পাওয়া দুষ্কর হইতেছে। যে দেশের এই অবস্থা, সে দেশে সরকার হাজার ডাকিলেও বিদেশি বিনিয়োগ আসিবে না। নিয়ম বদলাইয়াছে, ভাল কথা কিন্তু সেই ভরসায় থাকিলে চলিবে না। সত্যই যদি বিদেশি বিনিয়োগ আনিতে হয়, তবে এই ছবিটি বদলাইতে হইবে। |