মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ যে দেশের মধ্যে শীর্ষ স্থানে, তাহা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পরিসংখ্যানে আগেই স্পষ্ট হইয়াছে। পরিসংখ্যানের লজ্জা ঢাকিতে রাজ্য সরকার এ ধরনের অপরাধের প্রকৃত সংখ্যা দিল্লিতে না-পাঠাইবার সিদ্ধান্ত করে। কিন্তু জনসাধারণের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা তো তাহাতে বদলাইবার নয়। কেবল সুটিয়া কাটোয়া কামদুনি নয়, খাস কলিকাতাতেও মহিলারা নিত্য নিগৃহীত হইতেছেন। দুষ্কৃতীরা যোধপুর পার্কের মতো এলাকার রাজপথে অতিথি বিদেশিনির পিছু ধাওয়া করিতেছে, হাত ধরিয়া টানাটানি করিতেছে, শ্লীলতাহানি করিতেছে, ধর্ষণেও উদ্যত হইতেছে। ইহা দেখাইয়া দেয়, কলিকাতা-সহ সমগ্র রাজ্য ক্রমশই মহিলাদের জন্য নিরাপত্তাহীন হইয়া উঠিতেছে।
এক সময় পশ্চিমবঙ্গ এবং কলিকাতা মহিলাদের স্বচ্ছন্দ চলাচলের সুযোগের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। প্রেক্ষাগৃহে ‘নাইট শো’ দেখিয়াও মহিলারা নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরিতে পারিতেন। আজ সেই সব দিনরাত্রিকে রূপকথা মনে হয়। কলিকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গ এখন সত্যই মরূদ্যানে পরিণত হইয়াছে। দুষ্কৃতীদের মরূদ্যান। ইহা এক দিনে হয় নাই। দীর্ঘ কাল ধরিয়া প্রশাসন দুর্বল হইতে দুর্বলতর হইয়াছে। দুষ্কৃতীদের পিছনে রাজনীতির প্রশ্রয় বাড়িয়াছে। অপকর্ম করিলেও পুলিশ সহসা তাহাদের ধরিতে চায় না, এলাকাবাসীর চাপে ধরা পড়িলেও চার্জশিটে লঘু অভিযোগ দিয়া তাহাদের জামিনের আগাম বন্দোবস্ত করা থাকে। লক-আপ কিংবা জেল হেফাজত হইতে দ্রুত বাহিরে আসিয়াই নিগৃহীতাদের মুখ বন্ধ করিতে শাসানি দেওয়া শুরু হয়। এ সকলই পুরাতন ব্যাধি।
কিন্তু ‘পরিবর্তন’ এই ব্যাধিগুলির প্রশমন ঘটায় নাই, বরং আরও বাড়াইয়া তুলিয়াছে। প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের সহিত যুক্ত হইয়াছে প্রকাশ্য এবং অনেক সময়েই চিৎকৃত প্ররোচনা। শাসক দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা জনসভায় বক্তৃতা করিয়া পুলিশকে বোমা এবং সি পি আই এমকে জুতা মারিবার পরামর্শ বিতরণ করিতেছেন। আবার স্থানীয় দলনেতা স্কুলে ঢুকিয়া শিক্ষকের উপর চড়াও হইবার পরে মন্ত্রী তাঁহাকে ‘তাজা ছেলে’ বলিয়া প্রশংসা করিতেছেন। অন্য দিকে শহরে কোনও নারী নিগৃহীত হইলে শাসকরা প্রশ্ন তুলিতেছেন, তিনি কেন অধিক রাত্রে বাড়ির বাহিরে গিয়াছিলেন। কেহ কেহ আবার নিগৃহীতার চরিত্র লইয়াও সংশয় জ্ঞাপন করিতেছেন। শাসকের কাজ যে নাগরিকদের সুশাসন দেওয়া, দুষ্কৃতীদের অপকর্মকে সুকৌশলে বৈধতা দেওয়া নয়, শাসকরা ইহা বিস্মৃত হইলে দুষ্কৃতীদের দুঃসাহস বাড়িবে, তাহা নিতান্ত প্রত্যাশিত।
দুষ্কৃতীরা যদি উত্তরোত্তর দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হইয়া ওঠে, শাস্তি, এমনকী গ্রেফতারির ভয় হইতেও মুক্ত হইয়া প্রকাশ্যে দাপাইয়া বেড়ায়, তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে হাল হয়, এই রাজ্য তাহারই সাক্ষী। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ার, কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা দেখিলেই এই কথাটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জোর দিয়া বলিয়া থাকেন। ঠিকই বলেন। কিন্তু এক্তিয়ার তথা অধিকারের উল্টো পিঠেই থাকে কর্তব্য বা দায়িত্ব। আইনের শাসন বলবৎ রাখার সাংবিধানিক দায়ও রাজ্যের। সে দায় হইতে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা শাসকের পক্ষে সমূহ সঙ্কট ডাকিয়া আনিতে পারে। আজ পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া রাজ্য জুড়িয়া যে হিংসা, সন্ত্রাস, জবরদস্তি ও ভীতিপ্রদর্শনের আবহ রচিত হইয়াছে, অতীতে তাহা হইয়াছিল বলিয়াই ইহাকে যুক্তিসিদ্ধ করা যায় না। অতীতে এই অনাচারের বিরুদ্ধেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী নেত্রী হিসাবে প্রবল প্রতিবাদ শানাইয়াছেন। অথচ তাঁহার জমানায় অনাচারই আচার হইয়া উঠিতেছে, বিশৃঙ্খলাই স্বাভাবিক ‘নিয়ম’-এ পরিণত হইতেছে। ইহা পশ্চিমবঙ্গের লজ্জা। মুখ্যমন্ত্রীরও। |