|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
ভাগ ফোর্থ ক্লাব ভাগ
রোম অলিম্পিকে মিলখা... লস অ্যাঞ্জেলেসে ঊষা... লন্ডনে তিনি। সবার
কমন দুঃখ। রিভিউ করতে
গিয়ে কোথাও সেই চেপে রাখা যন্ত্রণা এ
ভাবে ধাক্কা দেবে ভাবতেই পারেননি শ্যুটার জয়দীপ কর্মকার |
বুঝতেই পারিনি হলে বসে কেঁদে ফেলব! বুঝতেই পারিনি, ফিল্ম দেখতে গিয়ে পুরনো যন্ত্রণাগুলো ফিরে আসবে জীবনে!
যদি জানতাম, ‘পত্রিকা’র হয়ে ফিল্ম রিভিউ করার অ্যাসাইনমেন্টটা নিতাম না। তবু ফারহানকে কুর্নিশ। প্রত্যেকটা ফ্রেমে একজন অ্যাথলিটকে যে এ- ভাবে আঁকা যায়, ছবিটা না দেখলে বিশ্বাসই হত না। তা’ও আবার অ্যাথলিটেরনামযদি হয় মিলখা সিংহ। কুর্নিশ পরিচালক রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরাকেও। ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড’টাকে এত জ্যান্ত করে ধরেছেন বলে। সিনেমা হলে অন্ধকার নেমে আসতেই যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। মন এতটাই হুহু করছিল যে ইন্টারভ্যালে ফোন করে বসলাম পিটি ঊষাকে। আমার গত বছরের লন্ডন অলিম্পিকস, পিটি ঊষার ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস... সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল মিলখা সিংহের ১৯৬০-য়ের রোম অলিম্পিকের সঙ্গে।
শুধু ফারহান আখতার নয়, গল্পটা তখন একান্তই আমাদের তিন জনের। মিলখা সিংহ, পিটি ঊষা আর আমার।
তিন জনই তো অলিম্পিকে ফোর্থ হয়েছি। পৃথিবীর সবচেয়ে মাইনরিটি একটা ক্লাবের সদস্য আমরা। এমন একটা ক্লাব, কেউ যেচে যার মেম্বারশিপ চায় না। প্রত্যেকটা জীবনেই তো চাওয়া-পাওয়ার ধাক্কাধাক্কি থাকে, সাদাকালোর চোরা টান থাকে। দৌড় যেমন থাকে, থাকে পিছলে যাওয়াও। সেলুলয়েডে কোনও বড় মাপের মানুষকে ধরলে সেই আঁকাবাঁকা টানের, এবড়োখেবড়ো রাস্তাগুলো কেমন যেন হাওয়া হয়ে যায়। ফোকাসটা তখন একজন সফল, কৃতীকে ভগবান বানিয়ে দেওয়া। রাকেশ আর ফারহান দু’জনেই এই মিথ্যে খেলায় নামতে চাননি। তাই বোধহয় একজন অ্যাথলিট হিসেবে ছবিটা দেখতে দেখতে নিজেকে সারা ক্ষণ ‘আইডেন্টিফাই’ করে গেলাম।
তা বলে কি ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ কোনও তথ্যচিত্র? না। ‘বায়োপিক’? না। এখানে মিলখার জীবন আছে, পুরোদস্তুর আছে। আবার সেখান থেকে হয়তো বা বেরিয়ে আসাও আছে। কিছুটা বাণিজ্যিক কারণে, বিনোদনের খাতিরে। সে দিক থেকে ছবিটাকে সত্যি ঘটনানির্ভর ফিকশন বলা চলে।
শুরুটা ১৯৬০-য়ের রোম অলিম্পিক থেকে। বিশ্বরেকর্ড ভেঙেও যেখানে মিলখা শেষ করেন চতুর্থ হয়ে। তার পর চলে গিয়েছে ফ্ল্যাশব্যাকে। যেখানে পঞ্জাবের এক প্রত্যন্ত গ্রাম গোবিন্দাপুরায় বড় হতে থাকে ছোট্ট মিলখা (যবতেজ সিংহ)। তাকে ঘিরে তার বাবা-মা, ভাইবোন সবাই। মিলখার স্বপ্ন ফৌজি হওয়ার। এর পরই মাথার ওপর ভেঙে পড়ে দেশভাগ। চোখের সামনে বাবাকে বুলেটে ঝাঁঝরা হতে দেখে মিলখা। মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ার আগে সন্ত্রস্ত, বিহ্বল, বিধ্বস্ত মিলখাকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলেন তার বাবা ‘ভাগ মিলখা ভাগ’। সে যেন আর পিছু ফিরে না চায়। শুরু হয়ে যায় মিলখার দৌড়। কিন্তু এই ডাক আর ফিরে তাকানো তাকে গোটা জীবন তাড়িয়ে বেড়ায়। |
|
ভাগ মিলখা ভাগ
ফারহান, সোনম, পবন |
মিলখা দিদিকে (দিব্যা দত্ত) খুঁজে পায় ভারতে। এ পারের মাটিতেই তার বাড়তে থাকা, কখনও চুরি-ডাকাতি করে বখে যাওয়া, কখনও প্রেমে পড়া, ফৌজি জীবনে ঢোকা, হাবিলদার গুরুদেব সিংহর (পবন মালহোত্রা) কাছে দৌড়ের তালিম নেওয়া ... ছোট্ট ছোট্ট ক্যানভাসে হালকা তুলির আঁচড়ে কাহিনি গড়াতে থাকে। একে একে আসে এশিয়াড, কমনওয়েলথ, অলিম্পিক। ফারহান তো অসাধারণ। পুরো ফাটিয়ে অভিনয় করেছেন পবন। এক দিকে ঘোরতর কঠিন স্বভাবের কোচ, অন্য দিকে অদ্ভুত এক পিতৃস্নেহে মিলখাকে ছায়া দেওয়া এক মানুষ এই গুরুদেব। দুটো অংশেই দর্শককে একেবারে পাকড়ে ধরেছেন পবন মালহোত্রা।
চমকে দিয়েছে শিশু অভিনেতা যবতেজ। ওর মায়ামাখা চাউনিটা বোধহয় কোনও দিনও ভুলব না। তার সঙ্গে ওর ক্ষিপ্রতা। ‘স্লামডগ মিলিয়েনেয়ার’য়ের বাচ্চাগুলোকে মনে করাচ্ছিল। পোড়ো বাড়ির দাওয়ায় মাকে খুঁজতে এসে ওর ছুটে বেড়ানো, তার পর রক্তমাখা কাদা আর শ্যাওলায় হঠাৎ পিছলে যাওয়াটা এতটাই রিয়েলিস্টিক, বুকের কাছে কেমন ধক করে লাগে। তুলনায় মিলখার প্রেমিকার চরিত্রে সোনমকে যেন খুঁজেই পাওয়া গেল না। তাতে সোনমের কিচ্ছু করার নেই। কাহিনির চলনটাই ওকে আড়াল করে দিয়েছে।
স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি মিলখা সিংহর জাতীয় স্তরের কোচ রণবীরের অভিনয় (যোগরাজ সিংহ) দেখে। ক্রিকেটার যোগরাজ যে এত বড় ন্যাচারাল অ্যাকটার কে জানত! ও এমন একটা লুক ধরে রেখেছে, বাজি রেখে বলতে পারিমাঠে-ময়দানে ঘোরাঘুরির অভ্যাস থাকলে অমন চেহারার অন্তত দু’শো জনকে আপনি দেখেছেন।
ছবিটার বড়সড় জোর হল কাহিনি বলার সরলতা। তাতে ভয়ংকরতা, বীভৎসতার পাশে পরের পর উঠে এসেছে মুঠো মুঠো মিষ্টি ফ্রেম। গ্রামের পাড়ায় স্পিকার লাগিয়ে রেডিয়োয় একজোট হয়ে লোকজনের মিলখার দৌড়ের ধারাবিবরণী শোনা, ন্যাশনাল ব্লেজারের মাপ দিতে দরজির সামনে মিলখার লজ্জা পাওয়া, সেই ব্লেজার দিদির গায়ে পরিয়ে দেওয়া, ওঁর প্রথম বার প্লেনে উঠে আতঙ্কে পাগল হয়ে যাওয়া...!
দেখতে দেখতে ভেতর থেকে উঠে আসা কেমন একটা মুগ্ধ করা আবেশ গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ‘ভাগ মিলখা ভাগ’য়ের রিভিউ যে আমাকে করতে হবে, সেটা আগে জানতাম না। |
|
রিলিজের আগে এমনিই গত সপ্তাহে মিলখা সিংহকে ফোন করেছিলাম। সে দিন অবশ্য আর বিশেষ কিছু ভাবিনি। ডায়াল করেই দিলাম ওঁর নম্বর।
ফোন করলাম, নিজের পরিচয় জানালাম। সব কথা উনি মন দিয়ে শুনলেন।
আর তার পরেই ফোনের ওপার থেকে বললেন, “ওহ, আপ ভি ফোর্থ ক্লাব মেঁ হ্যায়।”
বললাম, “ইয়েস মিলখাজি। ম্যায় ভি হু ফোর্থ ক্লাব মেঁ।” কথাটা বলতে গিয়ে বুঝলাম গলাটা একটু হলেও ওঁরও কাঁপছিল, আমারও।
অনেক কথা হল সে দিন মিলখাজির সঙ্গে।
ভেবেছিলাম যে-কথাগুলো উনি বললেন, সেগুলো হয়তো দেখতে পাব সিনেমাতে। কিন্তু পরে যখন সিনেমাটা দেখলাম সেই ব্যাপারগুলোর উল্লেখ দেখলাম না।
কী বললেন মিলখাজি?
এক কথায় বলতে গেলে বুঝতে পারলাম, আজও মনটা ওই ফোর্থ হওয়া ফিনিশ লাইনেই পড়ে আছে ওঁর।
আমাকে বললেন, “জয়দীপ, আমার কোচ জানো তো আমায় বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন আমি রেসের শুরুতে বেশি জোরে ছুটছি, তাই শেষ একশো মিটারে দম থাকছে না। এক বিদেশি কোচও আমাকে রেসের আগে বলেছিলেন আমার এবিলিটি আছে কিন্তু স্ট্র্যাটেজিটা ঠিক নয়। আজও ভাবি, ওঁদের কথা শুনলে জীবনটাই অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু ফাইনালের ওই অ্যাড্রিনালিন রাশে সব ভুলে গিয়েছিলাম।” বুঝতে পারলাম এক নিশ্বাসে কথা বলে ঢোক গিললেন মিলখাজি। আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলেন ‘ফ্লাইং শিখ’।
এমনিতে সেমিফাইনাল হিটসের পরের দিন ফাইনাল রেস হয়। কিন্তু সেই অলিম্পিকে নাকি সেমিফাইনালের দু’দিন পর ছিল ফাইনাল।
আমাকে বললেন, “জয়দীপ, ঠিক পরের দিন রেস হলে জানো, ইতিহাস অন্য রকম হতেও পারত। যে মুহূর্তে ফাইনালে উঠলাম তার পরের ৪৮ ঘণ্টা যে কী পরিমাণ প্রেশার ছিল আমার উপর, তা ভাবতেই পারবে না। একটা গোটা দেশ তাকিয়ে আছে আমার দিকে, ওই দু’দিন আমার মাথার মধ্যে শুধু এটাই ঘুরছিল। কে জানে, পরের দিন ফাইনাল হলে হয়তো অনেক হিসেবই ওলটপালট হতে পারত।”
আমিও যখন ফোর্থ হয়েছিলাম, পরের মুহূর্তে একটা উচ্ছ্বাস গ্রাস করেছিল। এই পৃথিবীতে আমি ফোর্থ তো আফটার অল! |
|
তার পরের মুহূর্ত থেকেই বদলাতে শুরু করে মনটা, বদলাতে শুরু করে পৃথিবীটা। একটা অদ্ভুত খারাপ লাগা গ্রাস করে মনকে। মনে হয়, এটা আমার সঙ্গেই কেন হল?
ভাগ্যের উপর রাগ হয়, দুঃখ হয়। আর একটা জিনিসও উপলব্ধি করে মানুষ। দেখবেন, অনেক সময় কিছু খারাপ হলেই আমরা ভাগ্যকে দুষি। কিন্তু জীবনে এমন অনেক সময়ই আসে যখন শুধু কপালের জোরেই আমাদের জীবনে অনেক ভাল জিনিস ঘটে যায়। কিন্তু আমরা এমনই যে, তখন কিন্তু একবারও বলি না, ভাগ্য ভাল ছিল বলেই এটা করতে পারলাম। তখন কিন্তু আমরা নিজেরাই ক্রেডিট নিই। অন্যদের বলি, “আরে, আমি ঠিক কাজ করলাম বলেই তো হল। ভাগ্য আবার কী!”
অলিম্পিকে ফোর্থ যদি হতেন তা হলে এটা আপনি আর কোনও দিন বলতেন না।
ওই থার্ড আর ফোর্থ-এর মধ্যে দাঁড়িয়ে আপনার ভাগ্য। তাই যাঁরাই অলিম্পিকে ফোর্থ হয়েছেন তাঁরা ভাগ্যের মাহাত্ম্যটা বোঝেন।
মিলখাজি আর ঊষার তো আর উপায়ও নেই এই ফোর্থ ক্লাবের মেম্বারশিপ ছাড়ার। কিন্তু আমি তো ভাগ্যবান। পরের বার রিও-তে আর একটা চান্স পাব।
হয়তো তখনও ফোর্থ হতে পারি। হয়তো লাইফ মেম্বার হয়ে যেতেই পারি ওই ক্লাবটার। কিন্তু ভবিষ্যৎ কে দেখেছে!
এই চার বছরের মেম্বারশিপ ছেড়ে হয়তো অন্য ক্লাবে চলে গেলাম।
ব্রোঞ্জ ক্লাব হতে পারে। সিলভার ক্লাব হতে পারে। আর ছোট ছোট গুড লাক, যেগুলো এখন জড়ো করছি, সেগুলোর দৌলতে হয়তো সোনাও হতে পারে... ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ তখন আর সিনেমা নয়। আমার গল্প।
ভাগ জয়দীপ ভাগ। |
|
|
|
|
|