নজরে মুর্শিদাবাদ, বরাদ্দ খরচ হয়নি, বিদ্যুৎ নেই একশো গ্রামে
টাকা পড়ে তবু বহু গ্রাম অন্ধকার, দুর্গম
মুর্শিদাবাদ-জিয়াগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির ডাহাপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি গ্রাম সংসদ কুড়ুলপাড়া। ওই সংসদের বেলুন-বাঘিরাপাড়ায় থাকেন কালু শেখ ও তাঁর স্ত্রী ঠাণ্ডি বিবি। হতদরিদ্র দম্পতি, সরকারি খাস জমির উপর কোনও মতে টিকে থাকা কঞ্চির বেড়ার ঝুপড়ি, তার ভাঙাচোরা টালির চালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। অপুষ্টি, বয়সের ভারে দু’জনেরই শরীরের হাড়গুলো সাদা চোখেই গোনা যায়। এ রকম অসহায় মানুষদের জন্যই পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় শুরু হয়েছিল সরকারি খাতা-কলমে রয়েছে ‘আশ্রয়’ প্রকল্প।
কিন্তু প্রকল্প রয়ে গিয়েছে খাতায়-কলমে। টাকাও রয়ে গিয়েছে তহবিলে। কালু শেখের মতো যে সব বিপন্ন মানুষ আর একটু সহনশীল, একটু মর্যাদাপূর্ণ করতে পারত এই প্রকল্প, তাঁরা অবহেলিতই রয়ে গিয়েছেন। গোটা জেলায় ‘আশ্রয়’ প্রকল্পে ‘বিসমিল্লা’ বলা হয়নি।
অথচ গরিবের মাথা গোঁজার আয়োজনের জন্য প্রকল্প কম নেই। ‘আশ্রয়’-এর সঙ্গে রয়েছে ‘আমার বাড়ি’ ও ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকল্প। ওই সব প্রকল্প থেকে পাকা ঘর করে দেওয়ার জন্য মুর্শিদাবাদ জেলার নানা ব্লকে অন্তত হাজার খানেক গরিব পরিবারের মাথা থেকে বছর দেড়েক আগে খুলে নেওয়া হয়েছে পুরনো কুঁড়েঘরের চালা, জানালেন এক সরকারি কর্তা। পুরনো ছাউনি খুলে নেওয়ার পর দেড় বছর কেটে গিয়েছে, এখনও নতুন আচ্ছাদন তৈরি করে দেওয়া হয়নি।
এই বর্ষায় পুরনো খড়ের চাল বা টিনের চাল দাওয়ায় রেখে তার নিচে মাথা গুঁজে তাঁরা দিন কাটাচ্ছেন। প্রায় প্রতি ব্লকেই ৪০-৫০টি এমন পরিবার রয়েছে। তবে জেলা পরিষদের হিসেব বলছে, ইন্দিরা আবাসের টাকার প্রায় সবটাই অবশ্য খরচ হয়ে গিয়েছে।
ইংরেজ আমলে পাকা সড়কের দু’ পাশে নিকাশি ব্যবস্থা হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল নয়ানজুলি। পরবর্তী দেড়-দু’শো বছরে নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতির বদলে সরকারি নয়ানজুলি ভরাট করে দোকান ও বাড়ি তৈরির মহাযজ্ঞ চলেছে। কোথাও তা পঞ্চায়েত কর্তাদের সরাসরি মদতে, কোথাও তাঁদের নিষ্ক্রিয়তায়। কিন্তু মোটের উপর জেলা শহর ও তার লাগোয়া গ্রামগুলিতে নয়ানজুলির বেআইনি দখল এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের জন্য বেহাল হয়ে পড়েছে নিকাশি ব্যবস্থা।
পানীয় জল নিয়েও সমস্যার অন্ত নেই। আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত জেলাগুলির মধ্যে রয়েছে মুর্শিদাবাদ। বহু অঞ্চলে অবস্থা ভয়াবহ। অথচ এ জেলাতেই পানীয় জলের জন্য ‘স্বজলধারা’ প্রকল্পের কাজ কয়েক বছর ধরে থমকে রয়েছে।
আর্সেনিক দূষণমুক্ত পানীয় জল সরবরাহের ওই প্রকল্পটির এতটাই করুণ দশা যে বছর দুয়েক আগে প্রতিবাদ জানিয়ে জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ পদ থেকেই সরে দাঁড়িয়েছেন জ্যোৎস্না সেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে কর্মাধ্যক্ষ পদ ত্যাগ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, ওই বিষয়ে দল তাঁর পাশে না-দাঁড়ানোয় দলত্যাগ পর্যন্ত করেন আরএসপি-র ওই নেত্রী।
কাজে এমন অনিয়ম সম্ভব হচ্ছে, কারণ জেলা পরিষদের নিয়মিত কাজেই থেকে যাচ্ছে প্রচুর অনিয়ম। ভিজিল্যান্স ও মনিটরিং কমিটি, কিংবা ও জেলা কাউন্সিল, যেগুলির কাজই হল হিসেবপত্রের নজরদারি করা, তাদের সভা নিয়মিত হয় না।
এ বার গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সংকটে জেরবার হয়েছেন খড়গ্রাম, নবগ্রাম, সাগরদিঘি, কান্দি ও বড়ঞা ব্লকের বোরো ধান চাষিরা। এখনও বিদ্যুৎ সেংযাগ নেই ১২২টি গ্রামে, বলছে জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট। অথচ পশ্চাৎপদ এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের অর্ধেকেরও বেশি টাকা পড়ে রয়েছে। এমনকী নিজস্ব তহবিলেরও ৪৫ শতাংশ খরচ হয়নি মুর্শিদাবাদে, যা স্বচ্ছন্দে নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারত জেলা পরিষদ।
উন্নয়নের কাজে জেলার এমন হাল কেন?
জেলা পরিষদের বিদায়ী সভাধিপতি, সিপিএম সদস্য পূর্ণিমা দাসের অভিযোগ, তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বেশ কিছু প্রকল্পে টাকা দেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। আরও কিছু প্রকল্প ঠেলে দিয়েছে নানা সরকারি দফতরকে।
ফলে জেলা পরিষদের কাজ গতি হারিয়েছে।
বিরোধীদের অভিযোগ, কাজ করতে না পেরে সভাধিপতি দোষ চাপাচ্ছেন শাসক দলের উফর। জেলা পরিষদে তৃণমূলের পরিষদীয় নেতা বাণী ইসরাইল বলেন, “বিধানসভা নির্বাচনের পর ওঁরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছিলেন। তখনই পদত্যাগ করা উচিত ছিল।”
কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধ কেন উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াবে? ভাঙা ঘরে, খিদে-পেটে এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছেন কালু শেখ, ঠান্ডি বিবিরা।
খরচের খতিয়ান (মুর্শিদাবাদ)
২০১২-১৩ সালের হিসেব
কিছু প্রকল্প যাতে বরাদ্দের এক টাকাও গত অর্থবর্ষে খরচ হয়নি
• সেচ ও জলপথ - গ্র্যান্ট ইন এড (৩৩ লক্ষ) • কৃষি (৬ লক্ষ) • বিএমএস- স্বাস্থ্য (৫ লক্ষ) • কমান্ড এরিয়া ডেভলপমেন্ট অথরিটি (১১ লক্ষ) • ছাত্রী আবাস নির্মাণ (১৪ লক্ষ) • জেলাস্তরের রেকর্ড রুম(৮ লক্ষ) • বন্যা (৬৭ লক্ষ) • পরিবহণ (৯ লক্ষ) • ক্ষুদ্র সেচ- গ্র্যান্ট ইন এড (১৭ লক্ষ) • পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন অর্থ নিগম (১০ লক্ষ) • জওহর রোজগার যোজনা (৩৮ লক্ষ)
কয়েকটি প্রধান প্রকল্পে যত খরচ হয়েছে
প্রকল্প হাতে মোট টাকা পড়ে আছে খরচ হয়েছে (%)
মৎস্য- গ্র্যান্ট ইন এড ১২ লক্ষ ১২ লক্ষ ০.০৪
মুসলিম কবরের পাঁচিল ১৮ লক্ষ ১৪ লক্ষ ২১.১২
সার্ক গ্রামোন্নয়ন উদ্যোগ ১.১৫ কোটি ৮৭ লক্ষ ২৪.৪৮
উদ্বাস্তু কলোনি পরিকাঠামো ৩৬ লক্ষ ২৬ লক্ষ ২৬.৮০
স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনা ৮০ লক্ষ ৪৬ লক্ষ ৪২.১৪
পশ্চাৎপদ এলাকা উন্নয়ন তহবিল (বিআরজিএফ) ৯.০৪ কোটি ৫.২১ কোটি ৪২.৩৬
স্বজলধারা ৫.০৯ কোটি ১.০৭ কোটি ৭৮.৯৭
কমিউনিটি হেল্থ কেয়ার
ম্যানেজমেন্ট ইনিশিয়েটিভ
১.৩৩ কোটি ২৮ লক্ষ ৭৯.২৩
আমার ঠিকানা ৬.৩০ কোটি ৬৬ লক্ষ ৮৯.৫৭
উদ্যানপালন গবেষণা ২.৫৪ কোটি ১১ লক্ষ ৯৫.৬১
ইন্দিরা আবাস যোজনা ৩১.১৭ কোটি ২ লক্ষ ৯৯.৯২
তফসিলি জাতি ও উপজাতির
ছেলেমেয়েদের হস্টেল
৫ লক্ষ ১০০
পাইপে জল সরবরাহ ১ কোটি ১০০
পূর্ত ও সড়ক সেস ৭৪ লক্ষ ১০০
সম্পূর্ণ গ্রামীণ রোজগার যোজনা ৬৯ লক্ষ ১০০
সাংসদের উন্নয়ন তহবিল
অধীররঞ্জন চৌধুরী
আবু হাসেম খান চৌধুরী
মইনুল হাসান (রাজ্যসভা)
১ লক্ষ ১ লক্ষ ০.০৪
৪৫ লক্ষ ২৬ লক্ষ ৪১.৪২
২৮ লক্ষ ১ লক্ষ ৯৬.০৫
আমি গরিব মানুষ। যদি একশো দিনের কাজের প্রকল্প আরও বেশি হয় তবে উপকার হবে। এলাকার রাস্তার অবস্থাও খুব খারাপ। তারও উন্নতির প্রয়োজন আছে।
সুকু দাস: দিনমজুর, বেলপুকুর
রাস্তাঘাটের যতটা উন্নতি হওয়া উচিত ছিল তার কিছুই হয়নি। কয়েকটি এলাকায় এখনও পানীয় জল সরবরাহ হচ্ছে না। তবে জেলা পরিষদের আর্থিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ঠিক কাজ করেনি সরকার।
অভিজিৎ রায়: ওষুধ ব্যবসায়ী, নাকাশিপাড়া
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিলে ভাল লাগবে। সর্বশিক্ষা মিশনের টাকায় আরও বেশি করে স্কুল ভবন তৈরি হোক। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকেও ঢেলে সাজানো হোক।
সিরাজ মল্লিক: মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ, চণ্ডীপুর
ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বয়স সাড়ে তিন দশক। অথচ বহরমপুর লাগোয়া চালতিয়ায় বর্শায় হাঁঠু ডুবিয়ে চলতে হয়। পঞ্চায়েত কর্তাদের সাইনেই নয়ানজুলি ভরাট করা হয়।
আনোয়ারুল কাদের: শিক্ষক, চালতিয়া
বাড়ি পঞ্চায়তে। কিন্তু পঞ্চায়েত থেকে ব্যবস্থা না করায় জল খেতে হয় পুরসভার। বেহাল নিকাশি ব্যবস্থার জন্য নালার জলে রাস্তা ভেসে দুর্গতির শেষ থাকে না। এর একটা বিহিত এ বার হোক।
রিনা ভট্টাচার্য: গৃহিণী, জমিদারি
জেলা জুড়ে কোথাও পঞ্চায়েত এলাকায় সব্জি বিক্রেতাদের জন্য স্থায়ী ছাউনি হয়নি। হলে একটু উপকার তো হতই। আমাদের কথা আর কে ভেবে দেখে!
কৃষ্ণ হালদার: সব্জি বিক্রেতা, ভাকুরি



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.