তেরো বছরে নয় বার মুখ্যমন্ত্রীর অভিষেক! শিবু সোরেন-এর তৃতীয় পুত্র হেমন্ত সোরেন ঝাড়খণ্ডের নূতন মুখ্যমন্ত্রী হইলেন। পিতা শিবু সোরেন ইতিপূর্বে তিন দফায় এই আসনটি অলঙ্কৃত করিয়াছেন। এখন তাঁহার বয়স হইয়াছে, শরীরও ভাল যাইতেছে না। অতএব সিংহাসনে পুত্রের অভিষেক। ইহাকে পরিবারতন্ত্র বলা যাইবে কি না, কে জানে। তবে ইহা সম্ভবত গণতন্ত্র নয়। অবশ্য ঝাড়খণ্ডে কোনও নির্বাচিত সরকার ছিল না। গরিষ্ঠতা হারানো সোরেন-বিজেপি জোট গদিচ্যুত হওয়ায় রাজ্যপাল বিধানসভা জিয়াইয়া রাখিয়াছিলেন এমনই কোনও সম্ভাবনার অপেক্ষায়। অবশেষে তাহার পূরণ হইয়াছে।
এ বার ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জে এম এম) জোট বাঁধিয়াছে কংগ্রেসের সঙ্গে। আর সেই সূত্রেই লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল এবং নীতীশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দলের সঙ্গেও একটা বোঝাপড়া তৈয়ার হইয়াছে। ঝাড়খণ্ডে এই দলগুলি জে এম এমকে সমর্থন করিবে, বিনিময়ে জে এম এম বিহারে ওই দলগুলিকে। প্রদেশের বিভাজন হইলেও জনজাতির বিন্যাস বহুলাংশে আগের মতোই, দক্ষিণ বিহারে বহু জে এম এম সমর্থক রহিয়া গিয়াছেন। ওড়িশা, ছত্তীসগঢ় এবং পশ্চিমবঙ্গের জনজাতীয় এলাকায়ও কংগ্রেস ও জে এম এম-এর লেনদেনের সুযোগ আছে। আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের দিকে চোখ রাখিয়াই যে এই সব বোঝাপড়া, তাহাতে সংশয় নাই। রাজনীতি যে ‘সম্ভাব্যতার শিল্প’, তাহাতে সে দিন পর্যন্ত বিজেপির সহিত জোটবদ্ধ জে এম এম বা নীতীশ কুমারদের সঙ্গে কংগ্রেসের নূতন সমীকরণ রচনায় কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে এই সমীকরণে ঝুঁকি আছে। অন্তত জে এম এম-এর মতো দলের সহিত জোট বাঁধার মূল্য একটু বেশিই ভারী পড়িয়া যাইতে পারে। সঙ্গী হিসাবে এই দল ও তাহার নেতা শিবু সোরেনের ঐতিহ্য যেমন, তাহাতে প্রগাঢ় ভরসার অবকাশ কম।
স্বল্পমেয়াদি রাজনীতির এই আবর্তে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনীতির হাল কী দাঁড়াইতেছে? জনজাতির ক্ষমতায়ন, আদিবাসীদের উপর বহিরাগতদের দীর্ঘ দিনের শোষণ, বঞ্চনা ও অত্যাচার ঘুচাইয়া তাঁহাদের আপন ভাগ্যজয়ের অধিকার দিবে এই লক্ষ্যেই উত্তরপ্রদেশ কাটিয়া উত্তরাখণ্ড এবং মধ্যপ্রদেশ কাটিয়া ছত্তীসগঢ়ের মতোই বিহার কাটিয়া ঝাড়খণ্ড প্রদেশেরও সৃষ্টি। কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠী স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া ইহা করে নাই, ইহার পিছনে ওই তিন এলাকারই জনজাতীয় জনগোষ্ঠী তথা ভূমিপুত্রদের দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস ছিল। কিন্তু নবগঠিত প্রদেশগুলির মধ্যে ঝাড়খণ্ডই প্রথমাবধি চরম কুশাসনের মধ্যে পড়ে। ব্যাপক দুর্নীতি, সরকারি তহবিল নয়ছয় করিয়া রাজনীতিকদের ঐশ্বর্যবৃদ্ধি, ক্ষমতা হাতে পাইয়াই সাধারণ মানুষের প্রতি সেই আচরণ করিতে থাকা, যাহা এত কাল ‘বহিরাগত’রা করিত এক কথায় জনজাতীয়দের মধ্য হইতে একটি ক্ষুদ্র ক্ষমতাবান স্বার্থগোষ্ঠীর উদ্ভব হইল। জনকল্যাণ, রাজ্যের পরিকাঠামোর উন্নতি, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য-পরিষেবাকে দরিদ্র জনজাতীয়দের নাগালে আনিয়া দেওয়াকোনও বিষয়েই রাজ্যের শাসকরা নজর দেন নাই। বিজলি-পানি-সড়ক-এর সংস্থানও ঝাড়খণ্ডে হয় নাই, যাহা ছত্তীসগঢ়ে কিছুটা হইয়াছে। ঝাড়খণ্ড সেই তিমিরেই। কেবল সোরেন পরিবার আর এক জন মুখ্যমন্ত্রী পাইল। |